দেশের বৃহত্তম চালের মোকাম নওগাঁয় প্রতি কেজি চাল পাইকারিতে ৩-৪ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৫-৬ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রতি কেজি ধান-চাল পরিবহণে দুই টাকা খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। চালের দাম বাড়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
এদিকে সংকট মোকাবিলা ও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আমদানি খুলে দিলেও ভারতে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এতেও মিলছে না সুফল। চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় একদিকে উৎপাদন ঘাটতিতে ক্রমাগত ধানের মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে বাড়তি পরিবহণ খরচের মুখে সহসাই চালের বাজার কমার সম্ভাবনা নেই বলেও মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বছর বোরো মৌসুমে জেলার ১১টি উপজেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন ঘাটতি হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাবে মৌসুমের শুরু থেকেই হাট-বাজারগুলোতে ধানের আমদানি কমতে
থাকে। ধান সংকটের কারণে গত কয়েক মাস যাবত ধানের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে মৌসুমের শুরু থেকেই জেলার পাইকারি ও খুচরা বাজারে দফায় দফায় বাড়ছিল চালের দাম। কয়েক মাসে দফায় দফায় চালের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ হলো হাটবাজারে ধানের সংকট।
জানা যায়, সংকট মোকাবিলা ও চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীরা শুল্কমুক্ত অবাধ আমদানির সুযোগ চেয়েছিলেন। ব্যবসায়ীরা সে সুযোগ পাননি। ঘাটতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ করতে বিলম্ব হওয়ায় আমদানিও শুরু করা হয় দেরিতে। ততদিনে দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পায় এবং ভারতের বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। ফলে লোকসানের আশঙ্কায় ভারত থেকে চাল আমদানি করতে নিরুৎসাহিত হন জেলার মিল মালিকরা। এরই মধ্যে দেশে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় সপ্তাহের ব্যবধানে জেলার পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে ৩-৬ টাকা। বর্তমানে খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি চালের দাম ৫-৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি কেজি জিরাশাইল চাল ৬৫-৭০ টাকা, কাটারি ৭০-৭৫ টাকা, ব্রি-২৯ ৫৬-৫৮ টাকা, ব্রি-২৮ ৫৬-৫৮ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ ৫৪-৫৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে মোটা চালের সরবরাহ একেবারেই নেই বললেই চলে। এতে বাধ্য হয়ে নিম্নবিত্ত দিনমজুর শ্রেণির মানুষকেও চিকন চালের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। দফায় দফায় চালের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এই শ্রেণির মানুষ।
জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি মণ জিরা ধান এক হাজার ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার ৬৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত এক সপ্তাহ আগে এক হাজার ৫৫০ টাকা থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সম্পা কাটারি ধান প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৬৪০ টাকা থেকে এক হাজার ৪৬০ টাকায়। যা গত এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল এক হাজার ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার ৬২০ টাকায়।
শহরের হাট নওগাঁ মহলস্নার বাসিন্দা রিকশাচালক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, 'আগে মোটা চাল কিনতাম ৩৫-৩৮ টাকা কেজি। আর এখন বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো চাল নাই। ৫৪ টাকা কেজি দরে তিন কেজি চাল কিনলাম। বাজারে সবকিছুর দাম-ই বাড়তেছে। জিনিসপত্রের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে না খেয়ে মরা ছাড়া উপায় থাকবে না। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ডিজেলের দাম আবারও কমাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।'
শহরের পৌর খুচরা চাল বাজারের ব্যবসায়ী মানিক প্রামাণিক বলেন, 'ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর মিলগেটে বস্তা (৫০ কেজি) প্রতি চালের দাম ২০০- ২৫০ টাকা বৃদ্ধি করেছে মিলাররা। বাড়তি দাম দিলেও আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের তারা চাল দিতে চান না। মিলগেট থেকে বাজার পর্যন্ত চাল আনতে প্রতি ট্রাকে বাড়তি ৮০০-৯০০ টাকা পরিবহণ খরচ গুণতে হচ্ছে। বেশি দামে চাল কেনার কারণেই খরচ সমন্বয় করে মানভেদে প্রতি কেজি মোটা ও চিকন চালের দাম ৫-৬ টাকা বৃদ্ধি মূল্যে আমরাও বিক্রি করছি।'
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রম্নপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, 'বর্তমানে বাজারে ধানের সরবরাহ কম থাকায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ধান কেনার পর মিল পর্যন্ত আনতে প্রতি কেজিতে দুই টাকা বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে। তাই পরিবহণের বাড়তি খরচ সমন্বয় করে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম ৩-৪ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভারতে চালের দাম বেশি। তাই আমদানিকৃত চাল আদৌ আসবে কিনা? তা বলা যাচ্ছে না। আমাদের এমনিতেই প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে। এরই মধ্যে ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে পরিবহণ খরচও অনেক বেড়ে গেল। বাড়তি পরিবহণ খরচের মুখে সহসাই চালের বাজার কমার সম্ভাবনা নেই।