মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২
রাজশাহী-৬

'মনোকষ্টে' আ'লীগের তৃণমূল বিএনপিতে নতুনদের দাপট

বদরুল হাসান লিটন ও নজরুল ইসলাম বাচ্চু
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
'মনোকষ্টে' আ'লীগের তৃণমূল বিএনপিতে নতুনদের দাপট
'মনোকষ্টে' আ'লীগের তৃণমূল বিএনপিতে নতুনদের দাপট

পদ্মা পাড়ের বাঘা ও চারঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৬ সংসদীয় আসন। স্বাধীনতার পর এ আসনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুটি উপ-নির্বাচনসহ সাতটি সংসদীয় নির্বাচনের মধ্যে চারবার আওয়ামী লীগ, তিনবার বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এবং একবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচিত হন। এবার এ আসনে আওয়ামী লীগের তিনজন ও বিএনপির পাঁচজন নেতা দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে প্রয়াত আজিজুর রহমান এবং ২০০১ সালে সাবেক মন্ত্রী কবীর হোসেন বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে এমপি হয়েছিলেন। আর ১৯৯৬ সালে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আলাউদ্দিন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আনিসুর রহমান। তবে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিএনপির মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগে ফিরে যান ডা. আলাউদ্দিন। তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হলে ১৯৯৭ সালের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি এমপি হন এবং প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ডা. আলাউদ্দিন মারা যাওয়ার পর ১৯৯৯ সালের উপ-নির্বাচনে এখানে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা রায়হানুল হক রাহয়ান বিজয়ী হন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ঠান্ডু। ২০০১ সালের নির্বাচনে রায়হানুল হক রায়হান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও সেবার বিদ্রোহী প্রার্থী হন বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাস আলী। বিদ্রোহীর কারণে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান রায়হান। তবে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন ছিনিয়ে নেন শিল্পপতি শাহরিয়ার আলম। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি তিনবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ :২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা হওয়ার পর শাহরিয়ার আলম নিজ দলের নেতাকর্মীদের তুমুল বিদ্রোহের মুখে পড়েন। এমনকি এলাকায় শাহরিয়ার আলমকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরা। তবে মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বার এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে তৃতীয়বারের মতো এমপি হন শাহরিয়ার আলম। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা রায়হানুল হক রায়হান বিদ্রাহী প্রার্থী হন। এ নির্বাচনে অন্য দলের প্রার্থী না থাকায় বিদ্রোহীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে জয় পান এই শিল্পপতি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন। শাহরিয়ার আলম ছাড়াও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু ও সাবেক এমপি রায়হানুল হক রায়হান। এই তিনজনের মধ্যে দলের কেন্দ্রে শক্ত জায়গা করে নিয়েছেন শাহরিয়ার আলম। তবে তাকে নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। মুখ না খুললেও তৃণমূলের নেতাদের একটি বড় অংশ তার বিপক্ষে অবস্থান করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চারঘাট আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় সরকারি দলের সব ক্ষমতা এখন গুটিকয়েক নেতার হাতে। তাদের বাইরে আর কারও কথা কেউ শুনে না, মানেনও না। আর এ সুযোগে নানা অনিয়ম করে 'আঙুল ফুলে কলাগাছ' বনে গেছেন প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন নেতা ও ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত অনেকেই। তারা সাংসদ শাহরিয়ার আলমকে একটি বলয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন। অন্যদিকে সংসদ সদস্যকে কাছে না পাওয়ার মনোকষ্টে ভুগছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু বলেন, 'আমি রাতদিন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে সব ইউনিটের নেতাকর্মীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। তারাও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এর বাইরে এলাকার অসহায় মানুষদের পাশে যতটুকু সম্ভব দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।' সাবেক সংসদ সদস্য রায়হানুল আলম বলেন, 'আমি সবসময় জনগণের সঙ্গে আছি। এবারও নির্বাচনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রেখেছি। দল চাইলে অবশ্যই আগামী নির্বাচনে অংশ নিব।' বিএনপি : ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে তিনবার বিএনপির মনোনীত প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী নির্বাচনে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি। এবার এ আসনে দলটির মনোনয়ন চান স্থানীয় পাঁচজন নেতা। তারা সবাই নতুন মুখ। এর আগে তাদের অনেকেই একাধিকবার দলের মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হয়েছেন। যাদের অনেকেই ইতোমধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে থেকে দল সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। নিজের পক্ষে সমর্থন আদায়ে তৃণমূলের নেতাকর্মী ছাড়াও কেন্দ্রে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তারা। ফলে দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রয়েছে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব। এ আসনে এবার মনোনয়ন চাইবেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাইদ চাঁদ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেবাশীষ রায় মধু, আশির দশকের ছাত্রনেতা ও জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন, জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি নুরুজ্জামান খান মানিক ও জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন উজ্জল। এদের মধ্যে আবু সাইদ চাঁদ এক সময় জাসদ ও পরে জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। কখনো বিতর্কিত আবার কখনো জনপ্রিয় নেতা হিসেবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি ও চারঘাট বিএনপির সভাপতির পদে স্থান করে নেন আবু সাঈদ। তবে বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য তিনি দুইবার দল থেকে বরখাস্তও হয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রম্নয়ারি এবং ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বাতিল হয়ে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন আবু সাঈদ চাঁদ। অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন উজ্জল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। অন্যদিকে আশির দশকের ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত দেবাশীষ রায় মধু রাজশাহী কলেজ, গোলাম মোস্তফা মামুন সিটি কলেজ ও নুরুজ্জামান খান মানিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, 'বাঘায় আমার বাড়ি, আমার জন্মস্থান। আমি বিএনপির রাজনীতি করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। কখনো দলের কাছে কিছু চাইনি। সবসময় জনগণের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। এখনো কাজ করে যাচ্ছি। দল চাইলে আগামী নির্বাচনে বাঘা-চারঘাট থেকে এমপি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও রয়েছে আমার নিবিড় যোগাযোগ।' জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি নুরুজ্জামান খান মানিক বলেন, 'দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। ছাত্র অবস্থা থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমি দেশের জন্য, সমাজের জন্য রাজনীতি করি। দলের নেতাকর্মীরাও আমাকে কাছে টেনে নেন খুব সহজেই। এ কারণে আমাকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচনে ভালো করব।' আবু সাইদ চাঁদ বলেন, 'আমি মাটি ও মানুষের হয়ে রাজনীতি করি। নিজের জন্য রাজনীতি করি না। তাই মানুষ যদি চায় এবং দল যদি ইচ্ছে করে তাহলে আগামী নির্বাচনে আমি প্রার্থী হব। মনোনয়ন পেলে বিএনপির জন্য এ আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পারব।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে