বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

২৪ বছর পর রায়ের প্রায় কাছাকাছি মামলার বিচার

ডিবির সোর্স জালাল হত্যা
যাযাদি ডেস্ক
  ২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

দীর্ঘ ২৪ বছর পর রায়ের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সোর্স জালাল আহমেদ ওরফে শফিক হত্যাকান্ডের মামলার বিচার। আলোচিত এ মামলার বিচার চলছে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির দিন ঠিক করেছে।

আসামিপক্ষের এখনকার আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, 'আমি তদন্ত কর্মকর্তাকে চারদিন ধরে জেরা করেছি। মামলায় অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। নিহত জালালের দুই সন্তান পপি ও আব্বাসের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। তাছাড়া উদ্ধার হওয়া লাশ যে জালালের, তাই তো প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। তাই আমরা মনে করি, আসামিরা খালাস পাবে।'

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মাহফুজুর রহমান বলেন, 'আমরা সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে সাজার বিষয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। আগামী ৩০ মার্চ এ মামলায় আত্মপক্ষ শুনানি হবে। শুনানির পর যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণা করবেন আদালত।'

চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের পেশকার সাইদুর রহমান জানান, আসামিপক্ষ কোনো কারণে উচ্চ আদালতে না গেলে আগামী ৩ মাসের মধ্যে এ মামলার রায় আসতে পারে।

এ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তার সঙ্গে বিরোধের কারণে খুন হন জালাল। তার লাশ উদ্ধার হওয়ার পর দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পুলিশ বিভাগের দুর্নীতির তথ্য আলোচনায় উঠে আসে।

২০০১ সালে এ মামলায় অভিযোগ গঠনের পর এ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের কোনো স্থগিতাদেশ না থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য উপস্থাপন না করতে পারায় বিচার শেষ হতে দুই যুগ পার হয়েছে।

ওই বছর ১২ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর দেড় বছরের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষে ৪৫ জন সাক্ষীর ১৯ জনের সাক্ষ্য শেষ করেছিলেন আদালত। ২০০৩ সালে সাক্ষ্য দেন দুইজন, যার মধ্যে একজন আবার আংশিক সাক্ষ্য দেন।

মাঝে ১১ বছর কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি এ মামলায়। মামলায় নতুন করে গতি আসার পর ২০১৪ সালে চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। পরের বছর ২৫ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির তৎকালীন এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান মামলায় আংশিক জবানবন্দি দিয়ে আর আদালতে আসেননি। ফলে আরও ছয় বছর ঝুলে থাকে মামলার বিচার। সম্প্রতি তদন্ত কর্মকর্তা বাকি সাক্ষ্য দেন।

মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. জিয়াউল হাসান, হাবিলদার মো. বিলস্নাল হোসেন ও কনস্টেবল মো. আব্দুর রউফ জামিনে আছেন। পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল মালেক জামিন নিয়ে পলাতক। অন্য আসামি পুলিশ কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন ২০০১ সালে মারা গেছেন।

১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে ছাদের পানির ট্যাংক থেকে জালালের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।

ওই ঘটনায় লাশ শনাক্ত হওয়ার আগেই ১৯৯৯ সালের ২৬ মার্চ রমনা থানার অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন তৎকালীন এসআই এসএম আলী আজম সিদ্দিকী। লাশ শনাক্ত হওয়ার পর ওই বছর ৪ এপ্রিল নিহতের ছেলে আব্বাসউদ্দিন আরেকটি মামলা করেন।

আব্বাসউদ্দিনের মামলার এজাহার অনুযায়ী, নিহত জালাল ছিলেন মাইক্রোবাস চালক। প্রথমে নিজের মাইক্রোবাস চালাতেন। পরে নিজের মাইক্রোবাস বিক্রি করে ভাড়ায় চালাতেন। ডিবি পুলিশ কোনো গাড়ি রিকুইজিশন করলে সে গাড়ি চালানোর জন্য তাকে ডাকা হতো। সে কারণে ডিবি অফিসের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আসামি জিয়াউল হাসান ও এসআই আরজু প্রায়ই তাকে ডেকে নিতেন। ১৯৯৯ সালের ২০ মার্চ মোহাম্মদপুর থানাধীন লালমাটিয়ার বাসা থেকে গাড়ির লাইসেন্স ও চেক বই নিয়ে রাত ৩টায় ডিবি অফিসের উদ্দেশে বের হন জালাল। তারপর কয়েক দিন বাড়িতে না ফেরায় পরিবারের ধারণা হয়, তিনি ঢাকার বাইরে গেছেন।

ওই বছর ৩১ মার্চ কয়েকজন লোক বাসায় এসে জালালের ছবি দেখিয়ে পরিচয় জানতে চায়। এরপর পরিবারের লোকজন ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে জালালের লাশ শনাক্ত করে।

মামলার অভিযোগপত্রে হত্যার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় অবৈধ স্বর্ণ, হেরোইন ও মাদক চোরাচালানের তথ্য পাওয়ার জন্য জালালকে 'সোর্স' হিসাবে ব্যবহার করতেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক জিয়াউল আহসান। এ মামলার আসামিরা জালালের তথ্যের ভিত্তিতে চোরাকারবারিদের আটক করে চোরাচালানের পণ্য হস্তগত করতেন। কিন্তু জালালকে তার বখরা থেকে বঞ্চিত করা হতো।

১৯৯৯ সালের ১৩ মার্চ জালাল বিমানবন্দর এলাকায় একটি সোনা চোরাচালানকারী চক্রের তথ্য অন্য একটি গোয়েন্দা দলকে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হন জিয়াউল। ১৯ মার্চ রাতে অন্য আসামিদের সহযোগিতায় জালালকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে খুন করা হয়। আর লাশ লুকানো হয় ডিবি কার্যালয়ের ছাদে পানির ট্যাংকের ভেতরে।

ওই ঘটনা সে সময় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। হত্যাকান্ডের মাত্র ৫ মাসের মধ্যে ১৯৯৯ সালের ৯ আগস্ট সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মুন্সি আতিকুর রহমান আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

ওই বছরেই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক মুনিরা মাহফুজা। ৪৫ সাক্ষীর এ মামলায় ২০০১ সালের ১২ মার্চ শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।

মামলার নথি থেকে দেখা যায়, অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে প্রথম এ মামলায় বিচার শুরু করে ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। এ আদালত থেকে ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বদলি করা হয়।

এরপর ২০১৫ সালের ৩০ জুন দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বদলি করা হয়। মামলার বিচারকালে এ পর্যন্ত বহুবার বিচারক ও সরকারি কৌঁসুলি বদল হয়েছে।

বিচারের একপর্যায়ে মামলা পরিচালনায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বিরুদ্ধে। পরে ২০০১ সালের ২৮ জানুয়ারি বিচারপতি আলী আসগর খান ও বিচারপতি এসকে সিনহার হাইকোর্ট বেঞ্চ এক আদেশে পিপি পরিবর্তন এবং মামলাটির দ্রম্নত নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে