শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২
৫.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ

'ডাউকি ফল্ট' সক্রিয় হলে ঘটতে পারে মহাবিপর্যয়

বছরে দুই সেমি ইন্ডিয়ান পেস্নটের দিকে সরে যাচ্ছে বার্মিজ পেস্নট হ ইন্ডিয়ান পেস্নট ছয় সেমি সরছে ইউরেশিয়ান পেস্নটের দিকে
বীরেন মুখার্জী
  ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
'ডাউকি ফল্ট' সক্রিয় হলে ঘটতে পারে মহাবিপর্যয়
'ডাউকি ফল্ট' সক্রিয় হলে ঘটতে পারে মহাবিপর্যয়

বাংলাদেশে ফের আঘাত হেনেছে ভূমিকম্প। সোমবার সন্ধ্যায় অনুভূত হওয়া এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৩। গুগলের অ্যান্ড্রয়েড অ্যালার্ট সিস্টেমের তথ্য বলছে, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। সারাদেশেই এই কম্পন অনুভূক হয়েছে। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মেঘালয়ের রেসুবেলপাড়া থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। আর ঢাকার ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে ২৩৬ কিলোমিটার উত্তরে। ভূমিকম্প বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান এবং চীনেও অনুভূত হয়েছে। এর আগে সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ দুপুরে ৪ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা, যার উৎপত্তিস্থল ছিল টাঙ্গাইলে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুসারে উত্তরে তিব্বত সাব-পেস্নট, ইন্ডিয়ান পেস্নট এবং দক্ষিণে বার্মিজ সাব-পেস্নটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ তিনটি পেস্নটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ইন্ডিয়া পেস্নট, বার্মা পেস্নট ও এশিয়া পেস্নট। উত্তরে এশিয়া, পশ্চিমে ইন্ডিয়া ও পূর্বে বার্মা পেস্নট। ইন্ডিয়া পেস্নট ও বার্মা পেস্নটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সুনামগঞ্জ কিশোরগঞ্জ হাওড় হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে এই সাবডাকশন পেস্নট। এটাকে ভূতত্ত্ববিদরা সাবডাকশন জোন বলেন। সাবডাকশন জোনের পেস্নটগুলো খুবই বিপজ্জনক। ওই গবেষণার সময় ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ২৫টির মতো জিপিএস বসানো হয়। তার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ভূ-তত্ত্ববিদরা দেখতে পান যে, এই সাবডাকশন জোনে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রা শক্তি জমা হয়ে আছে। এই শক্তি যে কোনো সময়ে বের হয়ে আসতে পারে।

তথ্য অনুযায়ী, এই সাবডাকশন জোনে গত ৮০০ থেকে হাজার বছরে কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি। এই জোনের দক্ষিণে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার অংশে ১৭৬২ সালে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। সেই ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন ডুবন্ত দ্বীপ তিন মিটার ওপরে উঠে আসে। তাছাড়া সীতাকুন্ড পাহাড়ে কাদাবালুর উদগীরণ হয়। সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এলাকায় যে শক্তি জমা হয়ে আছে তার এখন পর্যন্ত বেরই হয়নি। সেটাই হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। রাজধানী ঢাকা থেকে ডাউকি ফল্টের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার এবং ইন্ডিয়া ও বার্মা পেস্নটের সাবডাকশন জোনের দূরত্ব অন্তত ৭০ কিলোমিটার।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, গত ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি। তবে প্রায় ১৩৫ বছরের এক হিসাব ধরলে ৭ কিংবা এর বেশি মাত্রার একটা ভূমিকম্প বাংলাদেশে হতেও পারে। তার ভাষ্য, 'বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় ভূমিকম্প হওয়ার মতো দুটি উৎস রয়েছে। এর একটি হচ্ছে ডাউকি ফল্ট এবং অন্যটি হলো সাবডাকশন জোন উত্তরে সিলেট থেকে দক্ষিণে কক্সবাজার, টেকনাফ পর্যন্ত। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো এ সাবডাকশন জোন। এই জোনের 'ডাউকি ফল্ট' সক্রিয় হয়ে উঠলে বাংলাদেশে ঘটে যেতে পারে মহাবিপর্যয়।'

ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের মতে, এ অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে ১৮৭০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তুরস্কের চেয়ে বড় মাত্রার যেমন- ৭ দশমিক ৫ ও ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০ থেকে ২৫০ বছর। ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সাইকেল হিসেবে সেটি এখনো ফিরে আসেনি। এরপর ১৮৮৫ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা হয়ত আরও ১০ থেকে ২০ বছর পর হতে পারে। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি ফল্ট লাইনে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সীমান্ত এলাকায় এরকম আরও ২ থেকে ৩টি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর আশপাশে এবং নোয়াখালীতে এরকম ফল্ট লাইন আছে। এরকম ১৫০-২৫০ বছরের যে সাইকেল আছে, সেটি কখন আঘাত হানবে কেউ জানে না। সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এ ছাড়াও যে কোনো সময় হতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ছোটখাটো ৬টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। সবগুলোই সাবডাকশন জোনের মধ্যে। ফলে এগুলোই বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ৫৭ বার ভূমিকম্প হয়েছে। এরপর চলতি বছর টেকনাফ, কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জ, দোহার, সিলেট ও চাঙ্গাইলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এতে কেঁপে ওঠে ঢাকা শহর। চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রামে ৪ দশমিক ৬ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়। এদিন দুপুর ১২টা ৫৬ মিনিটে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল অক্ষাংশ ২২ দশমিক ৯৩ ডিগ্রি উত্তর, দ্রাঘিমা ৯৪ দশমিক ১৯ ডিগ্রি পূর্ব মিয়ানমারের মাউলাইকে। রাজধানীর ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এর দূরত্ব ছিল ৪০০ কিলোমিটার। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৬। ২৫ এপ্রিল রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াই হাজার উপজেলায় ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভূগর্ভের প্রায় ১৭ কিলোমিটার নিচে। ৫ মে ঢাকার দোহারে ভূ-পৃষ্ঠের মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীর ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। সিলেটের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি ছিল আঁতকে ওঠার মতো। টাঙ্গাইলের ভূমিকম্পেও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন দেশের মানুষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল জানান, ছোট ছোট ভূমিকম্প প্রমাণ করে যে ভূ-অভ্যন্তরে শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে বড় ভূমিকম্প হওয়ার জন্য। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ডাউকি ফল্ট, পূবে ইস্টার্ন বাউন্ডারি ফল্ট কিংবা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আসামেও অনেক বড় বড় ফাটলরেখা আছে। 'ডাউকি ফল্ট' বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে শুরু করে একটি ভূতাত্ত্বিক ফাটলরেখা চলে গেছে ভারতের আসাম পর্যন্ত। এই ফাটলরেখাকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করেছি। এর যে কোনোটি সক্রিয় হতে পারে যেকোনো সময়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ভূমিকম্পের শতবছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। দেশে সবশেষ বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে। এছাড়া ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে। সে হিসাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট।

এছাড়া ২০০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে একটি হয়েছিল ১৮৬৯ সালে সিলেট অঞ্চলের কাছার এলাকায়। রিখটার স্কেলে এ কম্পনের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল, ১৯২৩ সালের দুর্গাপুরের ভূমিকম্পের এ অঞ্চল ভীষণ ঝুঁকিতে।

চলতি বছরের ২৮ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের উদ্যোগে 'বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি প্রশমন ও প্রস্তুতি' শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরে বলেছেন- বাংলাদেশ ৮.৩ থেকে ৮.৬ মাত্রার ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁঁকিতে রয়েছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা বলছে, ইন্ডিয়া পেস্নট পূর্ব দিকে বার্মা পেস্নটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মিজ পেস্নট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। আর এই মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে।

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, বার্মিজ পেস্নট বছরে ২ সে.মি. করে অগ্রসর হচ্ছে ইন্ডিয়ান পেস্নটের দিকে। অন্যদিকে বছরে ৬ সে.মি. করে ইউরেশিয়ান পেস্নটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ইন্ডিয়ান পেস্নট। আবার হিমালয়ের পাদদেশে নেপাল যে টেকটোনিক পেস্নটের ওপরে বসে রয়েছে, সেটার ওপরেই রয়েছে ভারতের উত্তর অংশ।

অন্যদিকে হায়দরাবাদ ভিত্তিক ন্যাশনাল জিওফিজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এনজিআরআই)-র গবেষণা অনুযায়ী, পৃথিবীর উপরিতলে থাকা বিভিন্ন পেস্নট ক্রমাগত নড়াচড়া করছে। একারণেই অস্বাভাবিকভাবে চাপ বাড়ছে হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে, যা বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে বড়সড় ভূমিকম্পের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে নেপালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার' প্রতিষ্ঠার। সিদ্ধান্তটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ওই বৈঠকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরির সিদ্ধান্তও হয়েছিল, যার কোনো অগ্রগতি হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে