বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মহাষ্টমীর স্নানোৎসবে ভক্ত-পুণ্যার্থীর ঢল

প্রতি বছর চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই পুণ্যস্নানে মিলিত হন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তারা বিশ্বাস করেন, এটি একটি পুণ্যকর্ম এবং এই স্নানের মাধ্যমে জাগতিক পাপমোচন হয়
যাযাদি ডেস্ক
  ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
মঙ্গলবার গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাটে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাষ্টমীর স্নানোৎসবে পুণ্যার্থীরা -যাযাদি

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুই দিনব্যাপী (সোম ও মঙ্গলবার) মহাষ্টমীর স্নানোৎসব যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। 'হে লৌহিত্য আমার পাপ হরণ করো' মন্ত্র উচ্চারণ করে ভক্ত-পুণ্যার্থীরা নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর তীরে, নাটোরের বারনই নদী এবং টাঙ্গাইলের যমুনা নদীতে মঙ্গলবার স্নান সেরে নিজেদের পাপ মোচনের জন্য প্রার্থনা করেন। প্রতি বছর চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই পুণ্যস্নানে মিলিত হন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তারা বিশ্বাস করেন, এটি একটি পুণ্যকর্ম এবং এই স্নানের মাধ্যমে জাগতিক পাপমোচন হয়। আমাদের জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের লাঙ্গলবন্দ এলাকার বিভিন্ন স্নানঘাটে মঙ্গলবার হাজার হাজার পুণ্যার্থীরা ডাব, দুর্বা, বেলপাতা, ফুল ও ফলমূলসহ পূজার বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে পুণ্যস্নান করেন। এ সময় প্রতি ঘাটে বসে থাকা পুরোহিতদের কাছে 'হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র, হে লৌহিত্য আমার পাপ হরণ কর'- এই মন্ত্র উচ্চারণ করে পাপ মোচনের আশায় ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করেন পুণ্যার্থীরা। স্নান করতে আসা পুণ্যার্থীরা জানান, পাপ মোচনের লক্ষ্য নিয়ে লাঙ্গলবন্দে পুণ্যস্নান করতে আসেন তারা।

লাঙ্গলবন্দ মহাষ্টমী স্নান উদযাপন কমিটির সদস্য সুরেষ কুমার সাহা বলেন, পুণ্যার্থীদের জন্য ২০টি স্নানঘাট সংস্কার করা হয়েছে। বিশুদ্ধ খাবারের জল সরবরাহের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৬টি নলকূপ। ১৫০টি অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ করেছে জেলা প্রশাসন। চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, পাঁচটি মেডিকেল টিম ও নারায়ণগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস ১০ শয্যাবিশিষ্ট অস্থায়ী হাসপাতালের ব্যবস্থা করেছে।

বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম এ মুহাইমিন আল জিহান জানান, স্নান উৎসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ঘাটগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাদা পোশাকে তৎপর ছিলেন। কন্ট্রোল রুম থেকে সব কিছু মনিটরিং করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল জানান, সনাতন ধর্মালম্বীদের স্নান উৎসবকে কেন্দ্র করে পুলিশ,র্ যাব ও সাদা পোশাকসহ দেড় হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। পুরো এলাকাজুড়ে ১০০-এর অধিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনিটরিং সেল বসানো হয়েছে।

হোসেনপুর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমী স্নানে লাখো পুণ্যার্থী অংশ নেন। মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১টা পর্যন্ত অষ্টমী স্নানে অংশ নেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

কিশোরগঞ্জ জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি সাংবাদিক প্রদীপ কুমার সরকার জানান, এ উৎসবে জেলার ১৩টি উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও, নান্দাইল, ঈশ্বরগঞ্জ থেকেও পুণ্যার্থীরা অংশ নেন।

অষ্টমী স্নান পরিদর্শন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনিন্দ্য মন্ডল, হোসেনপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুজন চন্দ্র সরকার, উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাশিতা-তুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জহিরুল ইসলাম নুরু মিয়া, সাধারণ সম্পাদক এম এ হালিম, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক শাহ্‌ মাহবুবুল হক, হোসেনপুর থানার ওসি নাহিদ হাসান সুমন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. তানভীর হাসান জিকো ও স্থানীয় নেতারা।

এ উপলক্ষে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীর, ঐতিহ্যবাহী কুলেশ্বরী বাড়ি, কাচারি মাঠ ও রামপুর বাজারে বসে অষ্টমীর মেলা। মেলায় দোকানিরা নানা খেলনা, মিষ্টিজাতীয় খাবার ও বাহারি গ্রামীণ পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন।

টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার ভোর থেকে ভুঞাপুর উপজেলার খানেরবাড়ি সরাতলা কালী মন্দিরসংলগ্ন যমুনা নদীতে স্নান শুরু হয়। পাপ মোচনের আশায় এবং দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন আগত পুণ্যার্থীরা।

ঘাটে পূজা করা পুরোহিত পিন্টু গোস্বামী জানান, চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়। পাপমোচনের আশায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যমুনা নদীতে স্নান করতে আসেন।

অন্যদিকে ভুঞাপুরে স্স্নুইসগেট এলাকায় স্নান উৎসব হয়েছে। স্নান উৎসবকে ঘিরে মেলার আয়োজন করা হয়।

অষ্টমী স্নান উৎসব আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ ঘোষ জানান, ভোর থেকে পুণ্যার্থীরা স্নানঘাটে এসেছেন পূজা অচর্না করতে। আগত পুণ্যার্থীদের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা করা হয়। স্নানোৎসবে ভক্তদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন।

ভুঞাপুর থানার ওসি মো. আহসান উলস্ন্যাহ বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্নানঘাটে পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া জেলা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স, থানা পুলিশ ও নৌপুলিশের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রামের চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র নদের রমনা ঘাট থেকে জোড়গাছ ঘাটের মধ্যবর্তী স্থানে নন্দির মোড়ের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ উৎসব পালিত হয়। উৎসব নির্বিঘ্ন করতে ১৪০ জন পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে ১৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক সহযোগিতা করেন।

স্নানোৎসব কমিটির সদস্য সচিব কর্ণধার বর্মা জানান, স্নান উৎসব সোমবার বিকাল ৪টা ২৪ মিনিট পর থেকে শুরু হয়েছে। তবে মূল স্নান মঙ্গলবার ভোর ৪টা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় বিকাল ৪টা ৫৬ মিনিটে।

পূজা উদ্‌যাপন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মিলন চন্দ্র বর্মণ জানান, এবারের স্নান উৎসবে ৫ লক্ষাধিক পুণ্যার্থী অংশ নেন।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুল ইসলাম জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে উৎসব নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে।

নলডাঙ্গা (নাটোর) প্রতিনিধি জানান, নাটোররে নলডাঙ্গা উপজলোর পূর্বসোনাপাতলি মহাশ্মশান ঘাট ও শ্যামনগর মহাশ্মশান ঘাটে বারনই নদীতে মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু হয়ে দিনব্যাপী এ পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়। পাপমুক্ত হয়ে পুণ্য লাভের আশায় হাজার হাজার ভক্ত ও পুণ্যার্থীরা বারনই নদীর পূর্ব সোনাপাতলি মহাশ্মশান ঘাট ও শ্যামনগর মহাশ্মশান ঘাটে ভিড় জমান।

আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিধান চন্দ্র শীল বলেন, প্রতি বছর অষ্টমী তিথিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ভক্ত ও পুণ্যার্থীরা এখানে সমাবেত হন। এ উপলক্ষে গ্রামীণ মেলা বসে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী গঙ্গাস্নান অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মঙ্গলবার সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্ত ও পুণ্যার্থীরা পৌর এলাকার গোকর্ণঘাট তিতাস নদীর তীরে এসে সমবেত হন। পরে তারা তিথি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গঙ্গাস্নানে অংশ নেন। এই গঙ্গাস্নানের মধ্য দিয়ে ভক্তরা পরিবারের মঙ্গল কামনার পাশাপাশি দেশ ও জাতির জন্য বিশেষ প্রার্থনা করেন।

গঙ্গাস্নানে অংশ নেওয়া খোকন কান্তি আচার্র্য বলেন, গঙ্গাস্নানের মধ্য দিয়ে মনের বাসনা পূর্ণ হয়।

মায়া রানী মোদক জানান, গঙ্গাস্নানের মধ্য দিয়ে পরিবারের জন্যে মঙ্গল কামনা করেছি। দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায় শান্তি কামনা করেছি।

গঙ্গাস্নান পরিচালনা কমিটির সভাপতি রতন রায় কর্মকার জানান, গঙ্গাস্নানের জন্য স্থানীয়ভাবে বালির বস্তা ফেলে ঘাটটিকে উপযোগী করা হয়। এছাড়া ঘাটটি দখল দূষণের কবলে পড়ে অনেকটাই শীর্ণকায়ে পরিণত হয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীর কাছে ঘাট রক্ষায় সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।

এদিকে ঐতিহ্যবাহী এ গঙ্গাস্নানকে কেন্দ্র করে তিতাস নদীর তীর ঘেঁষে বসে লোকজ মেলা। মেলায় নাগরদোলা, হরেক রকম বাহারি খাবারসহ মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা দোকানের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে