মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
হাইকোর্টের নির্দেশও মানছে না সরকারি কর্মকর্তারা

চট্টগ্রামে ভূমিদসু্য চক্রের বিরুদ্ধে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির অভিযোগ

বিশেষ প্রতিনিধি
  ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
চট্টগ্রামে ভূমিদসু্য চক্রের বিরুদ্ধে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির অভিযোগ

চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার উত্তর চান্দগাঁও বড়বাড়ী নাথপাড়া এলাকায় ঘোষিত অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ভূমিদসু্য চক্র। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে জাল কাগজ সৃজনের মাধ্যমে এই অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির মহোৎসবে মেতে উঠেছেন ভূমিদসু্যরা।

এই ভূমিদসু্য চক্রের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেসসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টের নির্দেশনার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও তার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আসছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখার কর্মকর্তারা। একইভাবে নীরব ভূমিকা পালন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। বরং অর্পিত সম্পত্তির উপর ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে সুবিধা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে চউকের বিরুদ্ধে।

এছাড়া চান্দগাঁও সার্কেল ভূমি অফিসের কর্মকর্তার প্রতিবেদনে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির সত্যতা উলেস্নখ থাকলেও তা নজরে আনছে না কোন সংস্থা। এমন তথ্য জানিয়েছেন অর্পিত সম্পত্তি রক্ষা কাজে নিয়োজিত ভুক্তভোগী প্রিয়তোষ নাথ।

তিনি জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর চান্দগাঁও বড়বাড়ী নাথপাড়া এলাকার তপন কুমার নাথ (৬৪) ও স্বপন নাথসহ (৬২) স্থানীয় দুষ্কৃতকারীদের সংঘবদ্ধ একটি সিন্ডিকেট পাকিস্তান আমলে ঘোষিত মূল্যবান অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে তারা জাল কবলা ও খতিয়ানে শিমুল কান্তি নাথ (৫০) নামে এক ব্যক্তির কাছে ০১৭১ শতাংশ জমি ৩৩ লাখ ৬২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন।

একইভাবে কৃষ্ণ নামে এক ব্যক্তির কাছেও ০১৬০.১ শতাংশ নাল জমি দশ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। যার উপর শিমুল কান্তি নাথ চার তলা ভবন ও কৃষ্ণ একাধিক পাকাগৃহ-দোকান পাট নির্মাণ করে জোরপূর্বক ভোগ দখল করে আসছেন। একইভাবে তপন কুমার নাথ ও স্বপন নাথ ০.০১৫০ একর জমি দখল করে সেমিপাকা দোকান ও ভাড়া ঘর নির্মাণ করে ভোগ দখল করে আসছেন।

এ নিয়ে গত বছর ২৫ মে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন ঘোষিত অর্পিত সম্পত্তির মালিকপক্ষের ওয়ারিশ নয়ন দেবনাথ। অভিযোগটির মামলা নং ৮৩/৮০-৮১, ৮৩/৮১০৮২। অভিযোগে বলা হয়, চান্দগাঁও অফিসের আওতাধীন চান্দগাঁও মৌজার আর, এস খতিয়ান নং ৩৪৯৭ আর. এস দাগ নং ২৪৪৮ বি.এস দাগ নং ১২৬৮, জমির পরিমাণ ০.০১৭১ একর বাড়ি ভিটা ও ৭০৮ বর্গফুট পাকা গৃহ শ্রেণির ভূমি জনৈক তপন কুমার নাথ কর্তৃক জালিয়াতিক্রমে অবৈধভাবে দলিল সৃজন করে হস্তান্তর করেছেন। মামলাটি তদন্ত করে চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী ভূমি কমিশনারকে প্রতিবেদন প্রেরণের আদেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু দীর্ঘ ৬ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর বিষয়টি চান্দগাঁও ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. ইমাম উদ্দিন তদন্ত করে গত বছর ১৫ নভেম্বর চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী ভূমি কমিশনারের কাছে প্রেরণ করেন। সহকারী ভূমি কমিশনার ফেরদৌস আরা প্রতিবেদনটি ভিপি শাখায় প্রেরণ করেন। এই প্রতিবেদনে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কবলা ও খতিয়ান সৃজন করে এই অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির সত্যতা পাওয়ার তথ্য উলেস্নখ রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্ণিত বি. এস ৩০০৪নং খতিয়ানে ১২৬৮ দাগের ০.১৪ একর জমি শ্রেণি বাড়ি হিসেবে নিকুঞ্জ দেবনাথ গং (আট আনা) ও সুবল চন্দ্র নাথ। (চার আনা), পিং-ব্রজ নাথ, জ্ঞানদা বালা দেবী। (চার আনা), জং- শশী মোহন নাথ হাল সাং ভারত পক্ষে বাংলাদেশ সরকার।। (আট আনা) হিস্যাংশ মতে শুদ্ধরূপে জরিপ লিপি চূড়ান্ত প্রচারিত আছে।

কিন্তু বি. এস মালিক সুবল নাথ ও জ্ঞানদা বালা দেবী বিগত ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ইং হতে ১৬ ফ্রেব্রম্নয়ারি ১৯৬৯ ইং তারিখের মধ্যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বদেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ফলে নালিশি দাগের (আট আনা) অংশ ০.০৭ একর ও অন্যান্য দাগাদির সম্পত্তিসহ সরকার কর্তৃক অনাবাসিক সম্পত্তি হিসাবে ভিপি শুমারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

ভারতবাসী সুবল চন্দ্র নাথ এর সম্পত্তি ভিপি ক তালিকার গেজেটে সাবেক পি. এস ৬১৭নং খতিয়ানভুক্ত পি. এস ১৬৬৭ দাগের সামিল বি. এস ১২৬৮ দাগের আন্দর ০.০৭ একর ও অন্যান্য দাগাদির জমিসহ মোট ১.৫৫৫০ একর জমি গেজেট তালিকার পৃষ্ঠা নং- ৯২৪৮ ও ৯২৪৯ এবং ক্রমিক নং-২৮৯ এ অন্তর্ভুক্ত হয়। উক্ত ভিপি সম্পত্তিতে সরকারের যাবতীয় স্বত্ব স্বার্থ দখল ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান থাকাবস্থায় ভারতবাসী সুবল চন্দ্রের ওয়ারিশগণ সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এবং জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সরকারি ক তালিকাভুক্ত ভিপি সম্পত্তি রেজিস্ট্রি দলিল নং-৬১৭৪/২০২২ তাং-১৮/১০/২০২২ মূলে ০.০১৭১ একর জমি জনৈক শিমুল কান্তি নাথ, পিতা- হিমাংসু বিমল নাথ বরাবরে বিক্রয় করেন।

তর্কিত ভিপি সম্পত্তি ওয়ারিশ সূত্রে বিক্রয় করার আইনগত অধিকার কবলা দাতা তপন কুমার নাথ ও স্বপন নাথ পিতা- সুবল চন্দ্র নাথের নেই। তর্কিত সম্পত্তি ডিপি মামলা নং-৮৩/৮০-৮১ মূলে সরকারের ইজারাকৃত সম্পত্তি হওয়ায় আলোচ্য বি. এস ১২৬৮ দাগের আন্দর ০.০১৭১ একর জমি নিয়ে সৃজিত বিক্রীত দলিল নং-৬১৭৪, তাং-১৮/১০/২২ জাল ফেরবী এবং কু-উদ্দেশ্যে সরকারি স্বার্থ গ্রাস করার সামিল মর্মে প্রতীয়মান হয়।

তদন্তকালে একই ভিপি মামলাভুক্ত বি. এস ১২৮৩ দাগের আন্দর ০.০১৬০ একর ভিপি সম্পত্তি অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে অন্য একটি রেজিস্ট্রি দলিল নং-৬৮১৯, তাং-১৩/১১/২০২২ মূলে হস্তান্তরের প্রমাণ পাওয়া যার (অনুলিপি সংযুক্ত)। এ অফিসের রেজিস্টার ২ (তলববাকি) পরীক্ষান্তে দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ বর্ণিত ভিপি সম্পত্তির ভূমি উন্নয়ন কর কিংবা লিজ ফি পরিশোধ করেননি।

সরেজমিন তদন্ত করে দেখা যায়, তর্কিত বি. এস ১২৬৮ দাগের ০.১৪ শতক জমিতে শিমুল দেবনাথ, পিতা-হিমাংসু নাথ, ০.০২ একর (ভিপি সম্পত্তি) জমির উপর ৪ (চার) তলা ভবন, প্রদীপ নাথ, পিতা- মৃত প্রসন্ন নাথ ০.০২ একর (মালিকানা সম্পত্তি) জমির উপর সেমিপাকা ঘর, তপন কুমার নাথ, স্বপন নাথ, পিতা- সুবল নাথ ০.০১৫০ একর (ভিপি সম্পত্তি) জমির উপর সেমিপাকা দোকান ও ভাড়া ঘর, রতন দেব নাথ গং, পিতা-মৃত শশাংক নাথ ০.০১৫০ একর (মালিকানা সম্পত্তি) জমির উপর বেড়ার ঘর, দুলাল কুমার নাথ, পিতা- নন্দ কুমার নাথ ০.০১৫০ একর (মালিকানা সম্পত্তি) জমির উপর দোতলা পাকা ঘর, মন্টু গং, পিতা- প্রফুল নাথ, ০.০১ একর (ভিপি সম্পত্তি) জমির উপর বেড়ার ঘর, দুর্গা মন্দির ০.০২৫০ একর (ভিপি সম্পত্তি) জমির উপর, বিপস্নব নাথ ও রাসেল নাথ, পিতা- হরি শংকর নাথ ০.০১ একর (মালিকানা সম্পত্তি) জমির উপর সেমিপাকা ঘর ও খালি জমি, সুনীল গং, পিতা- মৃত রেবতী মোহন নাথ ০.০১ একর (মালিকানা সম্পত্তি) খালি জায়গা দখলে আছেন।

এমতাবস্থায় দাখিলীয় দলিলপত্র, ভিপি ক তফসিলের গেজেট তালিকা, রেজিস্ট্রি দলিল নং-৬১৭৪, তাং-১৮/১০/২২ ও ৬৮১৯, তাং-১৩/১১/২০২২, পি. এস ও বি. এস খতিয়ান ও বাস্তব দখল সার্বিক পর্যালোচনায় দাখিলীয় অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সরকারি ভিপি সম্পত্তি অবৈধ দখলকার ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে নানা রকম ফেরবী দলিল সৃজন করার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিগণের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এদিকে প্রতিবেদন প্রেরণের পর তিন মাস অতিবাহিত হলেও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি ভিপি সম্পত্তি বিক্রয়কারী ভূমিদসু্য চক্রের হোতা তপণ কুমার নাথ, স্বপন নাথ, শিমুল কান্তি নাথ ও কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ভুক্তভোগী প্রিয়তোষ নাথ গত ৩১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের জুডিশিয়াল বেঞ্চ বিচারপতি মিসেস নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের আদালতে এ বিষয়ে একটি রিট আবেদন করেন।

হাইকোর্টের বিচারপতিদ্বয় এ বিষয়ে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রয় ও ভোগ দখলের দায়ে বিবাদির বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভিপি শাখাকে আদেশ দেন। আদেশের কপি গত ২১ জানুয়ারি রিসিভ করেন ভিপি শাখা। সেই থেকে গত দুই মাস অতিবাহিত হলেও উচ্চ আদালতের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখার অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন ও মো. হেনার সহযোগিতায় অর্পিত সম্পত্তি শাখার একাধিক কর্মকর্তা তপন কুমার নাথ ও স্বপন নাথের নেতৃত্বে পরিচালিত ভূমিদসু্য সিন্ডিকেটে জড়িত। এছাড়া প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। বরং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল লোকজন ভুক্তভোগীদের বলেন, হাইকোর্টের বহু নির্দেশ এখানে পড়ে আছে। এগুলো আমাদের জন্য কিছুই না। বরং আমাকে ২০ হাজার টাকা দেন আমি তাদের তলব করব।

এ বিষয়ে জানতে গত ১৯ মার্চ (সোমবার) দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অর্পিত সম্পত্তি শাখার অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিষয়টি আমি জানি। এ সংক্রান্ত ফাইলটি আমার কাছে আছে। কাজটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে এ বিষয়ে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার এখতিয়ার আমার নেই।' এ সময় তিনি সহকারী কমিশনারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

কিন্তু ওইদিন ১৯ মার্চ (সোমবার) ও ২০ মার্চ (মঙ্গলবার) দুপুরে অফিসে গিয়েও সহকারী কমিশনার রাজীব হোসেনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। দুই দিনই তিনি অফিসের কাজে অফিসের বাইরে ছিলেন বলে জানান অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন। পরে ফোনে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি সাড়া দেননি।

জমি ক্রয়ের ব্যাপারে জানতে শিমুল কান্তি নাথের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে জমি ক্রয়ে রেজিষ্ট্রিকৃত দলিলে সাক্ষী থাকা তাপস কুমার নাথ বলেন, যাদের জমি তারা বিক্রি করেছে। অর্পিত সম্পত্তি হলে তো বিক্রয় করতে পারত না। তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি শিমুল কান্তি নাথকে বলব। কিন্তু এরপরে শিমুল কান্তি নাথ এবং তাপস কুমার নাথ কেউ কোনো কথা বলেননি।

এ বিষয়ে জানতে ভূমি বিক্রয় দাতা তপন কুমার নাথকে ফোন করা হলে তিনি মোবাইলে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব নয় জানিয়ে দেখা করতে বলেন। একই কথা বলেছেন স্বপন নাথও। কিন্তু পরে তাদের কেউ সাড়া দেননি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে