তিন কারণে দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদরা। কারণ তিনটি হলো-এক. এডিস মশা নির্মূলে সঠিক পদ্ধতি প্রয়োগ না করা, দুই. কার্যকরী কীটনাশক নির্বাচন না করা ও তিন. দেশের সচেতন নাগরিকদের মশা নিধনে সম্পৃক্ত করতে না পারা। তাদের মতে, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সংক্রমণ ও মৃতু্য কিছুটা কমে এলেও এখনো তা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। পরিস্থিতি সামাল দিতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদরা বলেন, কুরবানির ঈদের আগে ও পরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়েছে। ঢাকার অনেক নির্মাণাধীন ভবন, ফাঁকা বাড়ি, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, মাঠে, সড়কের পাশের গর্তে ও ড্রেনে এডিস মশা বংশ বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে। এ সময়ে এডিস মশার প্রজনন বাড়ে। ডেঙ্গুর 'পিক টাইম' শুরু হয় বর্ষা মৌসুমে। মশার আবাস ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে পারলেই এডিস মশা নির্মূল করা যাবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে তিনটি ধরনই সক্রিয়। এখনই সংক্রমন ঠেকানো না গেলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়, তৃতীয়বার আক্রান্ত হলে মৃতু্য হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। প্রথমবার আক্রান্ত হলে অনেকে বুঝতেও পারে না, সে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। একই ব্যক্তি বারবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সেটা পরিবারের জন্য মারাত্বক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়।
তারা বলেন, এ বছর ঢাকায় বেশির ভাগ মানুষ প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গেছে। অনেকের আবার দুই তিনবার ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। যারা একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তাদের অনেকের অবস্থা খুবই খারাপ। এ পরিস্থিতি থেকে অনুধাবন করা যাচ্ছে এবার রোগীর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি মৃতু্যর শঙ্কাও বাড়বে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, 'দেশে এডিস মশা নির্মূলে সঠিক পদ্ধতি প্রয়োগ হচ্ছে না। কার্যকরী কীটনাশক নির্বাচন করা যাচ্ছে না। দেশের সচেতন নাগরিকদের মশা নিধনে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। এডিস মশা গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। বাসাবাড়ির মশা এক পদ্ধতিতে নির্মূল করতে হবে। বন, জঙ্গল ও ঝোপের মশা ধ্বংস করতে অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। আমাদের মশা মারার কীটনাশক কোনো কাজ করছে না।'
কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার যায়যায়দিনকে বলেন, 'এডিস লার্ভা ধ্বংস করার জন্য জমে থাকা পানিতে কীটনাশক লার্ভা সাইড প্রয়োগ করতে হবে। এমনকি কেরোসিন বা বিস্নচিং পাউডারও দেওয়া যেতে পারে। এডিস মশা ধ্বংস করার জন্য ফগার মেশিন দিয়ে ধোয়া দিলে কোনো কাজে আসবে না। সেইসঙ্গে সে সব বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী আছে, সেখানকার উড়ন্ত মশা মারার ব্যবস্থা করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'মশা নিধনে নিজ নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয় পরিষদের জন প্রতিনিধিরা সেটা পর্যবেক্ষণ করবেন। মশা মারার ক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততা খুবই জরুরি। আমরা চাইলেই ডেঙ্গু কমিয়ে ফেলতে পারি।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্যমতে, চলতি বছরে ২১ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩ হাজার ৩১৫ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছে ৪১ জন। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৪১ জনের মধ্যে ২৯ জনেরই মৃতু্য হয়েছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে মৃতু্য হয় ২৫ জনের। উত্তর সিটিতে চারজনের। ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ আটজনের মৃতু্য হয়েছে বরিশাল বিভাগে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রোগীদের ৫১ দশমিক ২ শতাংশ নারী এবং ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ। শূন্য থেকে ২০ বছরের কম বয়সে মৃতু্য হয়েছে ২২ শতাংশ। ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সে ২৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং ৪০ ঊর্ধ্বে মৃতু্য হয়েছে ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। হাসপাতালে ভর্তি প্রতি ১০০ জন পুরুয়ের মধ্যে একজনের এবং নারীর ক্ষেত্রে মৃতু্যর হার প্রতি ৬৩ জনে একজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য তথ্য ইউনিটের (এমআইএস) ইনচার্জ ডা. মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম জানান, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৫৫ জন। তাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃতু্য হয়েছে। ফেব্রম্নয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩৩৯ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন। মার্চ মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩১১ জন এবং মারা গেছেন ৫ জন। এপ্রিলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৫০৪ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে ৬৪৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছেন ১২ জন। চলতি ২১ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ৪৬২ জন এবং মারা গেছেন ৫ জন।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, 'আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি, এই সময়ের বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা এডিস মশা প্রজননের জন্য উপযোগী। আমরা ধারণা করছি, জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে শেষে মশার ঘনত্ব, রোগীর সংখ্যা বাড়বে। সেটা আগস্ট ও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকবে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও খুলনায় ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, কুরবানির ঈদে অনেকেই গ্রামে গেছেন। এই মৌসুমে বাড়তি সচেতনতা থাকতে হবে। পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। সবাইকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মশা নিধনে কাজ করছে।