বায়ুদূষণের জন্য দায়ী কারণগুলোর অন্যতম পরিবহন। বিশেষ করে নগরীর বায়ুদূষণ। বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসেছে বিষয়টি। যানবাহন থেকে সৃষ্ট দূষণ কমাতে বিভিন্ন সময় নেওয়া হয়েছে প্রকল্প। তবে বাস্তবায়ন হয়নি। আটকে আছে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি অর্থায়ন না মিললেও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বরাবরই মিলেছে। যে কারণে আলোর মুখ দেখছে না জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো।
নতুন করে 'দ্য প্রজেক্ট ফর ইম্প্রুভমেন্ট অব ইকু্যইপমেন্ট ফর এয়ার পলুশন মনিটরিং' নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। মূলত এটি একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো নগরীর দূষণের কারণ সবার জানা। এজন্য নতুন করে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প দরকার নেই। আমাদের মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন দরকার।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী ঢাকা ও চট্টগ্রাম। দেশের বৃহত্তম দুটি নগরীর দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী পরিবহন। এসব পরিবহন কী পরিমাণে দুই নগরীকে দূষণ করছে তা পরিমাপের জন্য প্রকল্পের আওতায় দুই শহরের সড়কের পাশে বসবে আধুনিক জাপানি প্রযুক্তি। প্রতিটি যন্ত্র জাপান থেকে আমদানি করে সড়কের পাশে বসানো হবে। একেকটি যন্ত্র কিনতে সরকারের খরচ হবে সাড়ে সাত কোটি টাকার ওপরে। এই আধুনিক যন্ত্রের নাম দেওয়া হয়েছে এয়ার কোয়ালিটি স্টেশন।
পরিকল্পনায় জাপানি অর্থায়ন:পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, 'দ্য প্রজেক্ট ফর ইম্প্রুভমেন্ট অব ইকু্যইপমেন্ট ফর এয়ার পলুশন মনিটরিং' প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মূলত এটা একটি ফিজিবিলিটি প্রকল্প। এর আওতায় মোট আটটি জাপানি প্রযুক্তির যন্ত্র স্থাপন করা হবে। রাজধানীর উত্তরার হাউজ বিল্ডিং, বনানী, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী ও ধানমন্ডির সড়কের পাশে স্থাপন করা হবে এ স্টেশন।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের
সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) এবং বিএসআইর (বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন) জমিতে দুটি স্টেশন স্থাপন করা হবে। একটি স্টেশন থাকবে ভ্রাম্যমাণ। যানবাহন যে সব এলাকায় বেশি সে সব এলাকায় এটি টহল দেবে। এসব যন্ত্রপাতি ২৪ ঘণ্টা বায়ুর মান ও পরিবহন কী পরিমাণে দুই নগরীতে দূষণ বাড়াচ্ছে দেবে তার তথ্য।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও ব্যয়:পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, আধুনিক এ যন্ত্র ২৪ ঘণ্টা ডাটা সরবরাহ করবে। কোন পরিবহন কী পরিমাণে দূষণ করছে, দূষণ রোধে সরকারের করণীয় বিষয়ও নির্ধারণ হবে এর মাধ্যমে। দূষণ রোধে পরিবহন খাত পরিবর্তন ও আধুনিকতায় করণীয় বিষয়ে অবগত হতে পারবে সরকার। পরে পরিবহন খাত ঢেলে সাজানোর কাজ। পরিবহন খাতে বড় আকারে বিনিয়োগও করেতে চায় জাপান। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জাপানি প্রযুক্তি স্থাপনের পর এগুলো ১০ বছর সেবা দেবে।
প্রকল্পের প্রাক্কলিত মোট ব্যয় ১০৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৪১ কোটি ১১ লাখ এবং জাপানি অনুদান ৬৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। মার্চ ২০২৫ থেকে জুন ২০২৮ পর্যন্ত। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য রাস্তার পাশের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করা এবং সড়ক ও পরিবহন সম্পর্কিত দূষণে অবদান মূল্যায়ন করা।
বায়ুদূষণের মাত্রা নিরূপণে দুই শহরে রোডসাইড মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করা ও বায়ুদূষণ কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যন্ত্রপাতিগুলো আমদানি করা হবে জাপান থেকে। পরিবহন ছাড়াও অন্য যেসব কারণে বায়ুদূষণ হয় তা নিরূপণ, বায়ুদূষণের ফলে মানবস্বাস্থ্যের ওপর যে প্রতিকূল প্রভাব পড়ে তা নিরূপণ করাসহ বায়ুদূষণ সংক্রান্ত অন্য চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে সমাধানের কৌশল ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
প্রকল্পটির ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় অনুমোদন হয়েছে। সামনের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে যাচ্ছে প্রকল্পটি।
পরিবেশবান্ধব পরিবহনের জন্য ইলেকট্রিক বাস কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে এগুলো সরকারের নীতিগত অনুমোদন হয়নি। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে টাকা পায়নি। পরিকল্পনা আছে, কিন্তু অর্থ মিলছে না। ফান্ড সেটেল হয়নি। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ফান্ড সেটেল হচ্ছে না।- বিআরটিসির ডিজিএম (পরিকল্পনা) মো. আবু বকর সিদ্দিক
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মোহাম্মাদ আব্দুল মোতালিব বলেন, 'প্রকল্পের আওতায় মোট আটটি আধুনিক জাপানি প্রযুক্তির এয়ার পলুশন মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করা হবে। যন্ত্রগুলো এয়ার কোয়ালিটির ২৪ ঘণ্টা ডাটা দেবে। কাউন্ট করা হবে রোড সাইডের দূষণ। কী পরিমাণে পরিবহন দূষণ করছে তা আইডেন্টিফাই করা হবে। এর পরে সরকার পলিসি ঠিক করবে কি করা যায়।'
'দূষণ কেন হচ্ছে জানি, সমাধান দরকার':এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক বলেন, 'এটা নতুন কিছু নয়। এটা করার দরকার নেই। ঢাকা শহর প্রতিনিয়ত বিষাক্ত হচ্ছে এটা সবাই জানে। এর আগেও একই কাজে জাইকা প্রকল্প নিয়েছে। এখন এসব প্রকল্প নেওয়ার মানে নেই। আমাদের ইথিক্যাল প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে। শহরের পলুশন (দূষণ) কেন হচ্ছে জানি। আমাদের সমাধান দরকার।'
অর্থের অভাবে চালু হয়নি পরিবেশবান্ধব পরিবহন প্রকল্প: এর আগে দুটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় বিআরটিসি। তবে প্রকল্প দুটি অনুমোদন দেয়নি সরকার। মূলত আরও গভীরভাবে পরিকল্পনা ও অর্থায়নের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় আটকে আছে।
এর মধ্যে একটি ঢাকায় পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রিক পরিবহন। 'এনাবলিং ইলেকট্রিক ভেহিকল অ্যাডাপটেশন ইন ফ্রেমওয়ার্ক অব সাসটেইনেবল এনার্জি বেজড ট্রান্সপোর্টেশন' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি পরীক্ষামূলকভাবে গাড়ির চার্জিং স্টেশন স্থাপন করার উদ্যোগ নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন এবং মহাসড়ক বিভাগ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)।
আটকে আছে ১০০ দ্বিতল এসি বাস কেনা
এছাড়া দেশে প্রথমবারের মতো ১০০ বৈদু্যতিক দ্বিতল এসি বাস কেনার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। বাসগুলো কিনতে প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হওয়ার কথা এক হাজার ২৫২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। 'বিআরটিসির জন্য বৈদু্যতিক দ্বিতল এসি বাস সংগ্রহ' প্রকল্পের আওতায় এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে বৈদেশিক অর্থায়ন না পাওয়ায় মে ২০২৩ থেকে ৩০ জুন ২০২৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা থাকা প্রকল্পটিও থমকে আছে।
কেনা হয়নি ৩৪০টি বৈদু্যতিক কোরিয়ান এসি বাস:২০২৩ সালে 'গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বিআরটি রুট ও মেট্রোরেলের যাত্রীদের স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ৩৪০টি বৈদু্যতিক কোরিয়ান এসি বাস কেনার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু কোরিয়ান অর্থায়নের অভাবে বাসগুলো এখনো কেনা হয়নি। প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় এক হাজার ১৩৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৩০৪ কোটি ৮৩ লাখ এবং কোরিয়ান ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড ৮২৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথা।
কয়েক বছর ধরে প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা কমিশনে ঘুরপাক খাচ্ছে। টাকার অভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পরিবেশবান্ধব পরিবহন প্রসঙ্গে বিআরটিসির ডিজিএম (পরিকল্পনা) মো. আবু বকর সিদ্দিক বলেন, 'পরিবেশবান্ধব পরিবহনের জন্য ইলেকট্রিক বাস কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে এগুলো সরকারের নীতিগত অনুমোদন হয়নি। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে টাকা পায়নি। পরিকল্পনা আছে, কিন্তু অর্থ মিলছে না। ফান্ড সেটেল হয়নি। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ফান্ড সেটেল হচ্ছে না।'
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, 'ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন দূষণ হচ্ছে এটা সবার জানা। সুতরাং, প্রচলিত কাজে অনুদান হোক আর ঋণ হোক অর্থ খরচ না করাই ভালো। পরামর্শক খাতে ব্যয় বেশি থাকে বলেই সার্ভে বা পরিকল্পনা সংক্রান্ত প্রকল্প বেশি নেওয়া হয়। এটা বাস্তবায়ন হওয়ার পর মূল প্রকল্পে সেভাবে জোর দেওয়া হয় না, অনীহা দেখা দেয় সংশ্লিষ্টদের। এসব খাতে অর্থ খরচ করলে পরামর্শকদের উন্নয়ন হবে, পরিবহনের নয়।'