সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

তাজা ফলে 'শুল্ক' আগুন শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

এনবিআরকে করভার কমানোর সুপারিশ ট্যারিফ কমিশনের
মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
তাজা ফলে 'শুল্ক' আগুন শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা
তাজা ফলে 'শুল্ক' আগুন শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

'বিলাসী পণ্য' বিবেচনা করে তাজা ফল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করায় অস্থিরতা বিরাজ করছে দেশের ফলের বাজারে। গত এক বছরে আপেল, আঙুরের মতো ফলে তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে আমদানি শুল্ক। এতে সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে ফলের দাম, কমেছে বিক্রি। এদিকে, রমজান মাসে ফলের দাম আরও বাড়ার শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। যারা এই মাসে ফল বিক্রি করে আয় করতে চান তারাও রয়েছেন ঝুঁকির মুখে। ব্যবসায়ী বলছেন, তাজা ফল আমদানিতে শুল্ক কমানো উচিত সরকারের।

তথ্য অনুযায়ী, বছরজুড়ে বিক্রি হলেও রোজায় এসে চাহিদা বাড়ে দেশি-বিদেশি ফলের। বর্তমানে দেশি ফলের মৌসুম না থাকায় আপেল, কমলা, আঙুরসহ বিদেশি ফলের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু আমদানিতে দফায় দফায় সম্পূরক শুল্ক বাড়নোর কারণে ফল চলে গেছে সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে। কেরানীগঞ্জ, দোহার-নবাবগঞ্জসহ রাজধানীর সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, আপেল, কমলা, মালটা, আঙুরের মতো ফল কিনতে গেলে আগের চেয়ে কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি দাম চাইছেন বিক্রেতারা। ফলে মাসের খরচ মেলাতে গিয়ে প্রয়োজনমতো ফল তারা কিনতে পারছেন না।

বাবুবাজার এলাকার সেতু আফরিন নামে এক ক্রেতা বলেন, 'আগে যে পরিমাণে ফল কিনতে পারতাম, এখন আর সেটা পারি না। এখন যে অবস্থা হচ্ছে, সামনে হয়তো আর এসব বিদেশি ফল খেতে পারব না। ১০ দিন আগে মাঝারি আকারের কমলার কিনেছি প্রতি কেজি ২৬০ টাকা করে, যা এখন ২৯০ টাকা। ২৯০ টাকা কেজির আপেলের দামও বেড়ে হয়েছে ৩২০ টাকা।'

ক্রেতাসক্ষমতার কথা বিবেচনা করে ফলে শুল্ক কমাতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। কেরানীগঞ্জ কদমতলি এলাকার ফল ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, 'এর আগে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে আমদানি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। সম্প্রতি সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে পাইকারি বিক্রি আরও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমেছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ফলে ২০ থেকে ৩০ টাকা দাম বেড়েছে। কিছু ফলের দাম কেজিতে ৫০ টাকারও বেশি বেড়েছে। কালো আঙুর পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ৫০০ টাকায় কিনতাম, এখন কিনি ৫৩০ টাকায়। ছোট ডালিম ৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮০ টাকা হয়েছে। ২৭০-২৮০ টাকার নাশপতি পাইকারি বাজারে ২৮৮ টাকা হয়ে গেছে। পাইকারী বাজারের ওইদিকে দাম বাড়লে আমাদেরও দাম বেশি রাখতে হয়। এখন মানুষ ফল অনেক কম কিনছেন। সরকার যদি ট্যাক্সটা কমায় তাহলে ফল বিক্রি করে চলতে পারব।'

ফল আমদানিকারকদের সংগঠনের দাবি, বাজারে বিক্রি হওয়া ফলের ৬৫ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২

আপেল, কমলা, আঙুর, নাশপাতির মতো ফল আমদানিতে শুল্ক ছিল ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। তিন বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৬ দশমিক ২০ শতাংশে। অতিরিক্ত শুল্ক ও লোকসানের শঙ্কায় ফল আমদানিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রম্নটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নাজিম উদ্দীন বলেন, 'বিলাসী পণ্য হিসেবে আমদানিকৃত ফলের ওপর এক বছরে তিন দফায় ৬০ থেকে ৭০ টাকা সম্পূরক শুল্ককর বাড়িয়েছে এনবিআর। আপেল, আঙুর, কমলা হচ্ছে শিশুখাদ্য ও রোগীর পথ্য। এটা কীভাবে বিলাসী পণ্য হয়, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।'

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রম্নটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'ফল এখন সাধারণ মানুষ কিনতে পারছে না। আমরা যদি ১০০ টাকার ফল ইমপোর্ট করি, সেটাতে কিন্তু আমার রাজস্ব দিতে হচ্ছে, ট্যাক্স দিতে হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। কাজেই ফল মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আমাদের বেচাকেনাও কমে গেছে।'

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, বিশ্বের ২২টি দেশ থেকে ৩৮ ধরনের ফল আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশই আপেল, মাল্টা, কমলা, আঙুর ও আনার। আমদানি করা ফল বিলাসী পণ্য নয়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। অথচ বিলাসী পণ্য বিবেচনা করে আমদানি করা ফলে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ শতাংশ করা হয়েছিল। সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির বিবেচনায় ফল আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করলেও ফলাফল হয়েছে উল্টো। বরং আমদানি কমে যাওয়ায় কমেছে রাজস্ব আদায়। আসন্ন রমজানে ফলের বাজার স্থিতিশীল এবং সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে রাখতে ফল আমদানিতে বাড়তি শুল্ক-কর প্রত্যাহারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। গত ১৭ ফেব্রম্নয়ারি ফলে করভার কমানোর সুপারিশ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দেয় কমিশন।

চিঠিতে সংস্থাটি বলছে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও শুল্ক-কর বাড়ানোর কারণে আমদানি করা তাজা ফলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা ভোক্তার ওপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করেছে।

সম্প্রতি তাজা ফল আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করে এনবিআর। এখন তা আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে ট্যারিফ কমিশন। এ ছাড়া তাজা ফল আমদানিতে অগ্রিম কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক যৌক্তিক করারও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রম্নটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'ফল মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এ জন্য ট্যারিফ কমিশন এই প্রস্তাব করেছে। আমরাও একই দাবি নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে বসবো।'

চিঠিতে ট্যারিফ কমিশন জানায়, ডলারের দাম ও করভার বৃদ্ধির ফলে তাজা ফল আমদানি কমে গেছে। ২০২৩ু২৪ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় আপেল আমদানি ৫১ শতাংশ, মাল্টা ৭০ শতাংশ, আঙুর ২৯ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় গত জানুয়ারিতে মেন্ডারিন ৫১ শতাংশ, আঙুর ২১ শতাংশ, আপেল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, নাশপাতি ৪৫ শতাংশ, আনার ও ড্রাগন ৩২ শতাংশ আমদানি কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়। বর্তমানে ৮৬ টাকা মূল্যের ফল আমদানি করা হলে তার জন্য ১২০ টাকা কর দিতে হয়।

কমিশন জানায়, উচ্চ শুল্ককরের ফলে তাজা ফলের আমদানি হ্রাসের ধারা অব্যাহত থাকলে কেবল ভোক্তা সাধারণের স্বার্থ ক্ষুণ্‌ণ হবে না, বরং ভবিষ্যতে রাজস্ব আহরণও কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাজা ফল আমদানির পরবর্তী পর্যায়ে তেমন কোন প্রক্রিয়াজাত (মূল্য সংযোজন) করা হয় না; তাই অগ্রিম কর (স্থানীয় পর্যায়ের অগ্রিম ভ্যাট ৫ শতাংশ) আরোপ করা সমীচীন নয়। এর ফলে ব্যবসায়ীদের রিফান্ড নেওয়ার জন্য আবেদন করতে হয় এবং তাতে অনুমোদনের নিমিত্ত সময়ক্ষেপণসহ আর্থিক চাপের সম্মুখীন হতে হয়। আমদানি পর্যায়ে খাদ্য পণ্য হিসেবে ফলের ওপর এ ধরনের অগ্রিম কর (স্থানীয় পর্যায়ের অগ্রিম ভ্যাট ৫ শতাংশ) অব্যাহতি প্রদান করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ফ্রেসফুডস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, 'এবার যে সময়টায় রমজান মাস পড়েছে, বছরের ওই সময়টায় আমাদের দেশি ফল কম পাওয়া যায়। তাই তুলনামূলক রমজানে ফলের চাহিদা মেটাতে বিদেশি ফলের ওপর নির্ভশীলতা বেড়ে যাবে। তাই দাম যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেজন্য আমদানিতে শুল্ক কমানো উচিত।'

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, 'রমজানে খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত তদারকি করবে ভোক্তা অধিকার। খেজুরসহ সব ফলের দাম সহনীয় রাখতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে। দেশে বছরের খেজুরের চাহিদা ৮০ হাজার টন। যার মধ্যে রমজানেই লাগে ৬০ হাজার টন।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে