বারান্দ্রার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে অর্পিতা। চারদিকের আলো ঝলমল ভাব, মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। আকাশ হঠাৎ মেঘলা হয়ে উঠেছে। ঝড়ও আসতে পারে। ওর মনের ঝড়টা বেশি প্রকট। আজ তার হৃদয়ের সজীব অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। উদাস ভঙ্গিতে নিজের ঘরে বসে জানালা দিয়ে গাছ আর নাগরিক-পাখির সম্মিলন দেখছেন তিনি। প্রকৃত অর্থে তিনি নিঃসঙ্গ, বড় একা। বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে। চেতনায় দ্রোহী, লেখায় ক্ষুরধার আর অন্তরে প্রজ্ঞা নিয়ে যার বেড়ে ওঠা, তার আজ এ অবস্থা। চিন্তার পর চিন্তা এসে অর্পিতার মাথার মধ্যে পাক খেতে শুরু করে। আজ তার ভাইয়ের কথা খুব করে মনে পড়ছে। ওর ভাই বিষয়টি যেভাবে ভেবেছে ঠিক সেভাবে তার মাথায় আসেনি। কথায় বলে ওপরের দিকে তাকিও না। নিচে কী ঘটছে, তা দেখার চেষ্টা করো। এর সরল অর্থ, সম্ভবত প্রান্তিক পোড়খাওয়া সংগ্রামী যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের কথাই যেন বলা হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই অর্পিতা খাবারের ব্যাপারে অমনোযোগী উদাস ছিল। কোনো খাবারই পুরোটা শেষ করতে পারত না, অথবা করত না। সহজ ভাষায় যাকে বলা হয় অপচয়। কোনো খাবার সে অর্ধেক খেত, আবার কোনো খাবার আশি ভাগ। এ বিষয়টি তার ভাইয়ের একেবারে নাপছন্দ ছিল। তার কথা হচ্ছে মানুষ কেন খাবার অপচয় করবে। এ ব্যাপারে অর্পিতার বক্তব্য অন্য রকম। ও মনে করে, যেটুকু ওর প্রয়োজন সে টুকু খাবে, বাকিটা পেস্নটে পড়ে থাকবে উচ্ছিষ্ট হয়ে। খাবারের ব্যাপারে ওর স্বভাব এমনটা হলেও, মানুষের প্রতি ওর যথেষ্ট দরদ মায়া ভালোবাসা রয়েছে। মানুষের দুঃখে কাতর ও ব্যথিত হয়। ওর চোখে জল আসে।
খাবার সংক্রান্ত ভাইবোনের এই মতবিরোধের মধ্যে অর্পিতার ভাইয়ের বিয়ে চলে এলো। ভাইয়ের বিয়ে এ কথা ভাবতেই অর্পিতার আনন্দ যেন ধরে না। বিয়ের দিন সে রোস্ট-পোলাও খেতে গিয়ে অর্ধেক খেল। বিষয়টি ওর ভাইয়ের চোখ এড়াল না। তার শ্বশুরবাড়ির নতুন আত্মীয়দের সামনেই তার ভাই খাবার অপচয় নিয়ে তাকে অপমানজনক নানা কথা বলল। এ ধরনের কথা শোনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কথা শুনে ওর মনটা বিষাদে ভরে গেল, ভেতরে ক্রোধও জন্মাল। ভাই বলল, অর্পিতা তুই এভাবে খাবার অপচয় করছিস। অথচ গাজার শিশুরা ড্রেন থেকে খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছে, কেউ আবার খাবারের অভাবে মরে যাচ্ছে। তুই কি জানিস, বিশ্বে প্রতি চার সেকেন্ডে একজন মানুষ ক্ষুধায় মারা যায়। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ২১ হাজার মানুষ। বিশ্বের ১৩০ কোটি মানুষ অতিদরিদ্র, যাদের খাবার জোটে না। আমাদের দেশেই ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র। ভাইয়ের কথা শুনে ওর দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকল মুনমুন। যেন বিস্ময়ে ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
তখন সে চোখের সামনে ডুবন্ত সূর্যের দৃশ্য দেখতে পায়। অনেকক্ষণ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে সে রোদহীন বিকালের কথা চিন্তা করে। বিকালের রোগাটে আলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে লেপ্টে যাচ্ছে তার চোখের সামনে। অস্পষ্ট আলোর শেষ রশ্মিটা অন্ধকারের প্রথম ধাপের সঙ্গে যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার দলা পাকিয়ে সংক্রমিত হচ্ছে তার মনে। অন্ধকারে মশার পো পো ভনভন আওয়াজ উঠছে। একটা তাতানো দুঃখকে জিইয়ে রাখে অর্পিতা। গেল রাতে গাঢ় কিংবা হালকা কোনো ধরনের ঘুমই তার দুচোখ স্পর্শ করার সাহস পায়নি। ঘুমরাজি যেন সন্ত্রস্ত হয়ে অন্ধকার ঘরে অগোছালোভাবে ঘোরাফেরায় মত্ত ছিল। তামাম রাতের ছটফটানি কেবল চিন্তার বহর বাড়িয়ে নিজেকে সমস্যার ভারে নু্যব্জ করে রাখে যেন কোনোভাবেই তার হাত থেকে পালাবার জো নেই। কারণ সমাধানেরও কোনো পথ খোলা নেই। জীবনকে ছন্দময় করে তোলার যেন আর কোনো সুযোগ ও ইচ্ছে নেই। খাবার খেতে গেলেই ভয় হচ্ছে তার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে অনাহারি অসংখ্য মানুষের মুখ। যে মুখ বড় বিবর্ণ অসহায়, বাঁচার জন্য কাতর।