আধুনিক যুগের মুসলিম বাংলা সাহিত্যিকদের প্রথম সারির সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন মীর মশাররফ হোসেন। তিনি সেকালের খ্যাতনামা সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্রের (১৮৩৮-১৮৯৪ খ্রি.) কনিষ্ঠতম সমসাময়িক লেখক ছিলেন।
বহু প্রতিভার অধিকারী, মানবদরদি, সমাজহিতৈষী মীর মশাররফ হোসেন ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার নিকটবর্তী লাহিনীপাড়া গ্রামে বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। তার পিতা ছিলেন সে আমলের একজন নামকরা জমিদার।
মীর মশাররফ হোসেন বাংলার মুসলমান সমাজে ্আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যে ধারার সূচনা করেন। আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যিকদের অগ্রদূত ও বাংলা গদ্যের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। মীর মশাররফ হোসেন তার বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তিনি তার রচনাবলির বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে রূপদান করেছেন।
\হশৈশবে মীর মশাররফ হোসেন প্রথমে গ্রাম্য পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে কিছু দিন তিনি কুষ্টিয়া ইংরেজি স্কুলে এবং এক বছর পদমদীর নবাব স্কুলে লেখাপড়ার করেন।
ফরিদপুরের পদমদী স্কুলে লেখাপড়া করেন তিনি। সম্ভবত এর বেশি লেখাপড়ার সুযোগ তার ঘটেনি। কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি কিছুদিন ফরিদপুরের পদমদী নবাব এস্টেটে এবং কলকাতায় কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার জমিদারি এস্টেটে ম্যানেজারিতেই কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এস্টেটে কাজের সময়টাকেই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় মনে করা হয়। কারণ এখান থেকেই তিনি সামাজিক ও সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর 'গ্রামবার্তা' সম্পাদক হরিনাথ মজুমদার ওরফে 'কাঙাল হরিনাথ' তার সাহিত্যগুরু ছিলেন। তিনি তৎকালীন এই 'গ্রামবার্তা' এবং ঈশ্বর গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকা দুটিতে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন।
তার পূর্বে বাংলা গদ্য সাহিত্যে কোনো উলেস্নখযোগ্য মুসলমান সাহিত্যসেবী দেখা যায়নি। আধুনিক যুগে মুসলমান সাহিত্যসেবীদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন অগ্রপথিক। তার সাহিত্যকর্ম পরবর্তীকালে বহু মুসলিম সাহিত্য সাধককে চর্চার অনুপ্রাণিত করেছিল। অতি অল্প বয়সেই তার সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়। তার প্রথম গ্রন্থ 'রত্নাবতী' নামক উপন্যাস ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বের মাত্র ২১ বছর বয়সে রচিত ও প্রকাশিত হয়। তার সর্বশেষ গ্রন্থ 'আমার জীবনী' ১২ খন্ডে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। তার 'জমিদার দর্পণ' নাটক আত্মজীবনীমূলক, 'উদাসীন পথিকের মনের কথা' তার ব্যঙ্গ-বিদ্রম্নপাত্মক রচনা। 'গাজী মিয়ার বস্তানী' বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা সর্ববৃহৎ রচনা। মীর মশাররফ হোসেনের শ্রেষ্ঠ রচনা 'বিষাদ সিন্ধু' সেই ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি প্রায় ১৩৩ বছর সময় ধরে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে সমাদৃত আসন দখল করে আছে। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের সঙ্গে দামেস্কের অধিপতি এজিদের বিরোধ 'বিষাদ সিন্ধু' (১৮৮৫-১৮৯১ খ্রি.) তাকে বাঙালি পাঠক সমাজ তথা মুসলিম বিশ্ব চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
মীর মশাররফ হোসেন বাংলা কাব্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম বাংলা সাহিত্যের এক নব্য সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। সাহিত্যে রসগ্রন্থ রচনাতেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এছাড়া, উপন্যাস 'রত্নাবতী' থেকে 'বিবিকুলসুম বা আমার জীবনীর জীবনী' প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়ে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, সাহিত্য, সমাজচিত্র প্রভৃতি বিষয়ে এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত, অপ্রকাশিত ৩৩ খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। এখানে তার রচিত সমগ্র রচনাবলির সেই ৩৩ খানা গ্রন্থের পরিচিতি তুলে ধরা হলো- মীর মশাররফ হোসেনের সমগ্র রচনাবলি:
উপন্যাস: রত্নাবতী (২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ)
বিষাদ সিন্ধু (১৮৮৫-১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ)
উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০-১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ)
গাজী মিয়ার বস্তানী (১৮৯৮-১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) রস রচনা।
তহমিনা (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ)
বাঁধা খাতা (১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ)
নিয়তি কি অবনতি (১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ)
নাটক:
বসন্ত কুমারী (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ)
জমিদার দর্পণ (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ)
বেহুলা গীতাভিনয় (১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ)
যাত্রা:
টালা অভিনয় (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ)
প্রহসন:
এর উপায় কী? (১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ)
ভাই ভাই এইতো চাই (১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ)
ফাঁস কাগজ (১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ)
এ কী? (১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দ)
প্রবন্ধ:
গো-জীবন (১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ)
মুসলমানের বাংলা শিক্ষা (১৯০৩-১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ)
জীবনী:
আমার জীবনী (১৯০৮-১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ)
হযরত ইউসুফ (১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ)
বিবি কুলসুম বা আমার জীবনীর জীবনী (১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ)
কাব্য:
গোরাই ব্রীজ বা গৌরী সেতু (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ)
সঙ্গীত লহরী (১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দ)
পঞ্চনারী (১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দ)
মৌলুদ শরীফ (১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ)
ধর্মীয় গ্রন্থ:
খোৎবা(১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ)
প্রেম পারিজাত (১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ)
বিবি খোদেজার বিবাহ (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ)
হযরত বেলালের জীবনী (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ)
হযরত ওমরের ধর্মজীবন লাভ (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ)
হযরত আমীর হামজার ধর্মজীবন লাভ (১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ)
মদিনার গৌরব (১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ)
মোসলেম বীরত্ব (১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ)
ইসলামের জয় (১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ) গদ্য ও পদ্য।
তিনি 'হিতকরী' নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। 'আজিজুনরেহার' নামক মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, মুসলমান সমাজের পথপ্রদর্শক মীর মশাররফ হোসেন ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর প্রায় ৬৭ বছর বয়সে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।