সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

কথোপকথন

জাহিদ হোসেন
  ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কথোপকথন
কথোপকথন

রাত তিনটা। মোবাইলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ফোনটা রিসিভ করলে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসে।

-হ্যালো, কি করছেন? এখনো ঘুমাননি?।

-কে বলছেন?

-আপনি আমাকে চিনবেন না।

-এত রাতে মানুষকে বিরক্ত করা ঠিক না। আপনার পরিচয় দিন। তারপর কথা বলুন। তাছাড়া, পরিচয় দিয়ে কথা বললে অসুবিধা কোথায়?

-পরিচয় না হলে কি কথা বলা যাবে না? একটা ছেলে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বললে তো ভালোলাগার কথা।

-দেখেন এসব ন্যাকামি আমার একদম ভালো লাগে না। আমাকে বিরক্ত করবেন না, পিস্নজ।

-আমার পরিচয় নেবেন না। আগামীকাল দুপুর ১২টায় সুরভি পার্কে আসবেন। সাক্ষাতে কথা হবে।

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী চৌধুরী সাহেবের একমাত্র ছেলে আল মতিয়ার। এ বছর বিকম পাস করে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। আচার আচরণেও বেশ ভদ্র, নম্র। সবার জন্য তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন সব সময়।

সুরভি পার্ক। পার্কে কুটিরশিল্প মেলা বসেছে। আমাদের দেশের কুটিরশিল্প সামগ্রী সমগ্র পৃথিবীজুড়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। দূর অতীতে কুটিরশিল্পের যথেষ্ট কদর ছিল। আধুনিক যুগে পস্নাস্টিকের হরেক রকম বস্তু বাজারে আসায় কুটিরশিল্প সামগ্রীর চাহিদা কিছুটা অভাব দেখা দিয়েছে। কুটিরশিল্পের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো বর্তমানে বিলীন হতে চলেছে। বিলীনের পেছনে বহুবিদ কারণও রয়েছে। আঠার শতকে পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পবিপস্নব শুরু হয়ে উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে তার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। বিদেশ থেকে শিল্পজাত পণ্যের অবাধ আমদানি হওয়া এ দেশের কুটিরশিল্প মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের দেশে কুটিরশিল্পের মধ্যে রয়েছে তাঁতবস্ত্র, বোতাম, বিভিন্ন রকম মাটির বাসনপত্র, কাঠ শিল্পজাত দ্রব্য, অলংকার, বাঁশ ও বেতের কাজ উলেস্নখযোগ্য। পস্নাস্টিকের উৎপাদিত সামগ্রীর কারণে আমাদের দেশের কুটিরশিল্প বিলুপ্তির পথে। ধ্বংসপ্রাপ্ত কুটিরশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রতি বছর কুটিরশিল্প মেলা বসে।

\হমেলা শুরুর দিন থেকে একমাস চলবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। নাচ, গান, নাটক, সঙ্গীতসহ হলরুমে এক প্রাণবন্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এসব অনুষ্ঠানের মাঝে মানবতা বা মানুষত্ব বোধের তুলনায় লৌকিকতাই বেশি। সন্ধ্যাবেলা আলপনার প্রদীপ জ্বালিয়ে চলছে রং বেরঙের মুখোশ মিছিল। এসব সংস্কৃতি আমাদের আরোপিত, উত্তরাধিকার নয়।

মেলায় তপ্ত রোদ। গ্রীষ্মের প্রচন্ড রোদে মতিয়ারের বৃষ্টির মতো ঘাম ঝরছে। শার্ট ভিজে যাচ্ছে। ফোনের মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। মেলায় ডেকেছে। তার কাছে ঘটনাটা ভুয়া এবং সাজানো মনে হচ্ছে।

কয়েকজন বান্ধবীসহ ফারহানা এদিকে আসছে। ফারহানা খুবই বুদ্ধিমতি আর চালাক, সুন্দরীও বটে। চমৎকার সাজের অন্তরালে আপন রূপ সৌন্দর্য বিকশিত করে চলছে। বাতাসে চুলগুলো উসকো খুসকো হওয়ায় অপূর্ব দেখাচ্ছে। কলেজ ক্যাম্পাসে সবাই তার ব্যবহারে মুগ্ধ। সবার সুখে-দুঃখে হাসি মুখে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে।

মেলায় শত সহস্র লোকের ভিড়ে মতিয়ারকে দেখেও না দেখার ভান করে। তার বান্ধবী রিতা হাসি মুখে বলে- মতিয়ার ভাই আপনি তো ঘেমে যাচ্ছেন। আপনার ইয়ে কই?

-ইয়ে মানে কার কথা বলছো?

-কেন? আপনি কি একাই এসেছেন? ওনি আসেননি?

-তুমি এ সব কি কথা বলছ। তোমার কথায় আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

-থাক না, আমার সব কথা আপনাকে বুঝতে হবে না।

মতিয়ারের কথা শুনে সব বান্ধবী মহাখুশি। খুশির মহাপস্নাবন। কি চমৎকার দৃশ্য। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সমস্ত আঁধার দূর হলো। চাঁদের স্বচ্ছ ছোঁয়ায় ভরে উঠল হৃদয়। হৃদয় কাননে গোলাপের কুঁড়ি হিমেল বাতাসে সুরভিত ঘ্রাণ বিলাচ্ছে।

সবাই ক্লান্ত। চা-নাস্তা শেষে বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাৎ মতিয়ার বলে উঠল, প্রতিরাতে একটা মেয়ে আমাকে ফোন করে। কথা বলে। কিন্তু পরিচয় দেয় না। আজ মেলায় এসে পরিচয় হওয়ার কথা। কিন্তু মেয়েটি তো এলো না। ফাঁকিবাজ মেয়ে। ফারহানা বলল, ভাইয়া হয়তো এসেছে। দেখা করার অপেক্ষায় আছে। আমরা চলে গেলে দেখা করবে এবং কথা বলবে। আপনি মেয়েটাকে চিনেন?

না, কিন্তু তার কথাগুলো আমার পরিচিত।

ফারহানা, তুই থামতো। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না, পিংকি বলল।

আসমা বলল, ঠিক আছে আমি বলছি। মতিয়ার ভাই প্রথমে ক্ষমা চাইছি। প্রতিরাতে যে মেয়েটি আপনাকে ফোন করত, আপনার খোঁজখবর নিত, সেই মেয়েটি আর কেউ নয়। আমাদের ফারহানা। সে প্রাইমারি স্কুল থেকে আপনাকে ভালোবাসে। কিন্তু ভালোবাসার কথাটা প্রকাশ করতে পারেনি।

রিতা বলল, আসমা থাক না ওসব কথা। ওদের ভালোবাসা ওদের আবিষ্কার করতে দে।

এবার বিদায়ের পালা। আবিদা বলল, মতিয়ার ভাই আপনার হাতে ওটা কি? কার জন্য এনেছেন? দেখি দেখি এখানে কি আছে? বাবারে, বাবা। এটাতো মহামূল্যবান বইয়ের উপহার। সুন্দর হাতের লেখায় 'ফারহানা' লেখা। তাহলে কি আমরা ধরে নেব এটা আমাদের বান্ধবী ফারহানার জন্য? কী রে ফারহানা, তুই তো আমাদের কিছু বলিসনি। ফারহানা মিষ্টি হেসে বলল, আমি কী বলব। আমি কি জানি উনি আমার জন্য উপহার নিয়ে আসবেন। মতিয়ার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সুযোগ পেয়ে বলল, ফারহানা এটা তোমার জন্যই এনেছি।

ফারহানা রাতে শুয়ে শুয়ে মতিয়ারের কথা ভাবছে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফারহানার মনে একটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল। তন্দ্রাহীন রাতে মতিয়ারের মোবাইলটা বেজে উঠে। রিসিভ করলে আবার সেই মেয়ের কণ্ঠস্বর। মতিয়ার ভাই কি করছেন? এখনো ঘুমাননি?

- না মানে, প্রস্তুতি নিচ্ছি। কি ব্যাপার? এত রাতে ফোন?

- আপনার দেয়া উপহারটা বুয়ার মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি। বলুন! ভালো করিনি।

তার কথা শুনে মতিয়ারের ভীষণ রাগ হলো। ফোনটা বন্ধ করে দিল। ফারহানা এভাবে অপমান করবে, তা কখনো ভাবিনি। কথায় বলে, মেয়েদের মন আর আকাশের রং বদলাতে সময় লাগে না। কিছুক্ষণ পর আবার রিং আসে। ফোন আর মতিয়ার রিসিভ করে না। মোবাইলটা সাইলেন্ট করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুম আর আসে না। ঘর থেকে ছাদে ওঠে। পূর্ণিমা রাতের ছাদে পায়চারি করে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করে।

এ দিকে ফোন রিসিভ না করায় ফারহানার মুখটা কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। মতিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে এত রাতে দুষ্টমি করা মোঠেই ঠিক হয়নি।

নিন্দ্রাহীন রজনী। মতিয়ারের ঘুম আসছে না। বারবার রিং আসছে। কিন্তু মাহমুদ...। তবে এক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে ফোনটা রিসিভ করল। ভাইয়া, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার সঙ্গে দুষ্টমি করেছি। আপনার দেয়া উপহারটা আমাকে নব জীবন দান করেছে। আমি রিক্ত। আপনাকে দেয়ার মতো আমার কিছু নেই। শুধু ভালোবাসার একটা মন আছে। আমাকে ক্ষমা করবেন। এ দিকে মতিয়ার বাকহীন চেয়ে আছে জ্যোৎস্নার দিকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে