গ্রামের দোকান এবং বাড়ি মিলিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি টেলিভিশন। তন্মধ্যে বাজারের দোকানগুলো ছিল সদাআড্ডাবাজদের দখলে। আর বাড়িতে থাকা টেলিভিশন উঠানে প্রদর্শন করা হলেও ছিল মহিলাদের আধিক্য। কিশোর-যুবকদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তারা ব্যস্ত থাকত খেলাধুলায়। আড্ডায় খোশগল্পে। এই ছিল নিত্যকার চালচিত্র। যারা খেলাধুলায় পেরে উঠত না তারা ছিল অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন আড্ডাপ্রিয়। মাঝে মাঝে গ্রামের অলিগলি মেঠোপথ ধরে হেঁটে চষে বেড়ানো। ওটুকুই।
আমি ছিলাম আড্ডাপ্রিয়দের দলে। এই দলটি ছিল সংখ্যালঘু। এটা সম্প্রদায়ে নয়। যত সময় গড়িয়ে যায় তত আমাদের দলের পালস্না ভারী হতে থাকে। আমরা বিকালের সময়টায় আড্ডা এবং হেঁটে কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।
আলিফ লায়লা, সিনবাদ, ম্যাকগাইভার দেখতে হলে ছুটে যেতে হতো মানুষের বাড়িতে। আর দোকানে হলে ছিল অদ্ভুত ব্যবস্থা। কিছু খেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসতে দেওয়া। তারপর টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়ে উঠিয়ে দিত। মাঝে মাঝে ঝটিকা অভিযান চলত। সেটা ছিল অনেকটুকু নির্দয়। বেত কিংবা ছিপ দিয়ে তাড়াতে মারপিট। এক্ষেত্রে আমরাই ছিলাম তথাকথিত মুরুব্বিদের শিকার। দৌড়ে পালিয়ে রক্ষা পেতাম। এরই মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ ছিল গ্রামের উত্তর মাথায় গিয়ে ওইসব নাটক কিংবা বিদেশি প্রোগ্রাম দেখা। সেটাও ছিল আনন্দের শৈশব-কৈশোর।
একদিন রাতের বেলা। নিকষকালো অন্ধকার। কি ঘুটঘুটে কালো। নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যেত না। সেই রাতের আঁধারে রাস্তা দেখা অসম্ভব। রাতে কোনো চাঁদ-তারা না থাকলে এবং আকাশ যদি কালো হয় তাহলে কল্পনা করা যায়! যেহেতু গ্রামে বেড়ে ওঠা। রাস্তাঘাট অতিপরিচিত। তাই অনুমান নির্ভর হয়ে ঠিকঠাক বাড়ি ফিরে আসতাম। পথিমধ্যে ভয়ে কুঁকড়ে উঠতাম। তখন সুরা পড়ে গায়ে ফুঁ দিয়ে নিজের ভেতর সাহস সঞ্চার করতাম। কখনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ভর করলেও ক্ষতি হয়নি। সেই ছিল নিরাপদ শৈশব-কৈশোরের দিন। খুব প্রাণবন্ত সে সময় আজও বয়ে চলি নিজের ভেতর প্রাণপণ।
একসময় পত্রিকার পাতায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। সব নিউজ, ফিচার, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ও গল্প-কবিতা কিছুই বাদ পড়ত না। সবচেয়ে আনন্দ পেতাম বাণী চিরন্তনী পাঠে। শব্দজব্দ পূরণ করেও নিজেকে ঝালাই করতাম। একসময় কৌতুক পড়েও রস খুঁজে নিতাম। সেই সঙ্গে চলতে থাকে নিজে লেখক কিংবা কবি হওয়ার প্রচেষ্টা। সময়ে আবিষ্কার করতে পারি নিজেও কাব্যিক ভাবনায় তাড়িত হচ্ছি। যখন তখন ভাব আসতে শুরু করে। এক লাইন লিখি তো অন্য লাইন লেখার তাগিদ দিয়ে ফেরে মন। এক পর্যায়ে লেখাকে কবিতা মনে হলে পাঠাতে থাকি পত্রিকার ঠিকানায়। সম্পূর্ণ হাতে লেখা। পোস্ট অফিসই ভরসা। ই-মেইল তখনো আসেনি। পত্রিকা সংগ্রহ করে দেখতাম লেখা কতটুকু লেখা হয়েছে! ছাপা হলে নিজে নিজে গর্বিত হতাম। আর মাকে কিংবা ছোট ভাইদের কিংবা পরিচিত যারা আগ্রহী থাকত তাদের পড়ে শুনিয়েও কি আনন্দ! বাড়তি আনন্দ যোগ হতো ছাপা কাগজে নিজের নাম। পত্রিকার পাতা ভাঁজ করে হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরে রাখতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রাখায়ও কখনো ক্লান্তি ছিল না।
বাবা জানতে পেরে বাধ সাধেন। পড়ায় মনযোগী হতে বলেন। কিন্তু দমিয়ে রাখতে পারেননি। গোপনে কড়া অনুশাসনের মধ্যেও চলতে থাকে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ। আমি লিখে যেতে থাকি। আমাকে দিয়ে কেউ ভেতর থেকে লিখিয়ে নেয়। আমাকে লিখতে হবে ভেবে আরও বেশি বেশি পাঠে অভ্যস্ত হই। আমাকে পারতে হবে। চেষ্টা চলে কথাসাহিত্যিক হওয়ার। কিন্তু লিখতে যেয়ে কলম চলে না। মনের জোর আর কলম সমানতালে পেরে ওঠে না। মনকে আরও কঠিন করে প্রতিজন লেখকের স্টাইল রপ্ত করার চেষ্টায় কিছুটা আলোর মুখ দেখা। চলতে থাকে লেখালেখি। কবিতা বেশি। তাড়না বোধ করি গল্প, নাটক, গান লেখার। কিন্তু গানের ব্যাকরণ না জেনেও রচনা করি একাধিক গীতিকবিতা। সুর করি সুরের ব্যকরণ না জানা আমি। প্রশংসিত হই বন্ধুমহলে। ব্যাকরণের অজ্ঞাত দূর করতে বই সংগ্রহ করে পড়তে থাকি। এক সময় সফল হই। লিখে ফেলি গান। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে সেই গান রিলিজ হলে মনে সেই তৃপ্তি। আহা আমিও গীতিকার।