সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রথম নারী বের্টা ফন জুটনার

বের্টা তার বিখ্যাত উপন্যাস 'লে ডাউন ইয়োর আর্মস'-এর জন্যই ১৯০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। তিনি কেবল শান্তির কর্মীই ছিলেন না, তিনি উদার ধারণার চেতনা, উপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারী অধিকারের বিষয়েও সোচ্চার ছিলেন...
নন্দিনী ডেস্ক
  ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রথম নারী বের্টা ফন জুটনার
শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রথম নারী বের্টা ফন জুটনার

বের্টা ফেলিৎসিটাস জোফিয়ে ফ্রাইফ্রাউ ফন জুটনার (জার্মান : ইবৎঃযধ ঋবষরপরঃধং ঝড়ঢ়যরব ঋৎবরভৎধঁ াড়হ ঝঁঃঃহবৎ) একজন অস্ট্রীয় ঔপন্যাসিক এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম নারী কবি। ১৮৪৩ সালের ৯ জুন তৎকালীন চেকোস্স্নোভাকিয়ার (বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র) রাজধানী প্রাগ শহরের এক অভিজাত পরিবারে বের্টা জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের নাম জোফি ফন কোরনার এবং পিতা জোসেফ কাউন্ট কিনস্কি। বের্টার জন্মের আগেই তার বাবা মারা যান। বের্টার মা অস্ট্রীয় আভিজাত্যপূর্ণ উচ্চশিক্ষায় তাকে বড় করে তোলেন। মাতৃভাষা জার্মান ছাড়াও তিনি অন্য কয়েকটি বিদেশি ভাষা শিক্ষা করেন। বের্টা ফরাসি, ইংরেজি ও ইতালীয় ভাষায় অনর্গল কথা বলতে সক্ষম ছিলেন। তিনি প্রচুর পড়াশোনা ও ভ্রমণে আগ্রহী ছিলেন এবং সঙ্গীতেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। বের্টার বয়স যখন ত্রিশ বছর, তখনই তিনি ভিয়েনা শহরের কাছে এক গ্রামে অভিজাত এক ব্যারন পরিবারে গৃহশিক্ষিকার চাকরি গ্রহণ করেন।

১৮৭৬ সালে তিনি আলফ্রেড নোবেলের একটি বিজ্ঞাপনে সাড়া দেন এবং প্যারিসে নোবেলের বাসার গৃহকর্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

আলফ্রেড বের্নহার্ড নোবেল ছিলেন একজন সুয়েডীয় রসায়নবিদ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং অস্ত্র নির্মাতা। তিনি ডায়নামাইট আবিষ্কার করেছিলেন। ১৮৭৩ সালে ৪০ বছর বয়সে আলফ্রেড নোবেল প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হন। তখন থেকে নোবেল প্যারিস গিয়ে মালাকফ এভিনিউ এ থিতু হন। একই বছর আর্ডিয়ারের কারখানায় নাইট্রোগিস্নসারিন ও ডায়নামাইট উৎপাদন শুরু হয়।

আলফ্রেড নোবেল ১৮৯৬ সালে মৃতু্যবরণ করেন। নোবেল আমৃতু্য বের্টা ফন জুটনারকে ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও প্রিয়পাত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন। আর্থার নয় বছরের জন্য জর্জিয়ায় অবস্থান করেন। তারপর ভিয়েনায় ফিরে আসেন। জর্জিয়ায় কাটানো বছরগুলো বের্টার জন্য সুখকর ছিল না। প্রথমদিকে ভাষা এবং সঙ্গীত শিক্ষাদানের মাধ্যমে তারা রোজগার শুরু করেন। পরের দিনগুলোতে সংবাদপত্রের নিবন্ধন এবং বই লিখে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করতে সফল হয়েছিলেন।

অস্ট্রিরয়ায় ফিরে আসার পর বের্টা আন্তর্জাতিক শান্তি কার্যক্রম সম্পর্কে জ্ঞাত হন এবং এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৮৮৯ সালে 'জনৈক' ছদ্মনামে প্রকাশিত তার 'দ্য মেশিন এজ' গ্রন্থে তিনি তার বিশ্বাস সম্পর্কে লিখেছিলেন যে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিই যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। কারণ যুদ্ধ কেবল মানবজীবনই ধ্বংস করে না, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি করে।

'দ্য মেশিন এজ' গ্রন্থটি সফল হলেও, একই বছরের শেষের দিকে প্রকাশিত তার পরবর্তী উপন্যাস 'ডাই ওয়াফেন নিডার' (ইংরেজি অনুবাদ 'লে ডাউন ইয়োর আর্মস') তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল। লেখক ও শান্তিকর্মী বের্টার সর্বাধিক পরিচিত উপন্যাস 'ডাই ওয়াফেন নিডার'। ১৮৮৯ সালে ড্রেসডেনের প্রকাশক এডগার পিয়ারসন জার্মান ভাষায় উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিলেন। যুদ্ধ ও শান্তির প্রতি দৃষ্টিপাতের কারণে এবং সমাজের নারী জীবনের সমস্যার প্রতি আলোকপাত করার কারণে খুব দ্রম্নত উপন্যাসটি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। উপন্যাসটির পাঠকপ্রিয়তা ও প্রভাবকে কখনো কখনো হ্যারিয়েট বিচার স্টো-এর লেখা উনিশ শতকের সেরা বেস্ট সেলিং উপন্যাস 'আংকেল টমস কেবিন'-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। প্রথম প্রকাশের তিন বছর পরে এটি ইংরেজিতে 'লে ডাউন ইয়োর আর্মস' নামে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপরে ১৮৯৭ সালে ইতালীয় এবং স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাসটি। ১৯০৫ সালের আগেই উপন্যাসটির মোট ৩৭টি জার্মান সংস্করণ ছাপা হয়েছিল। এটি ফিনিশ, ডেনিশ, নরওয়েজিয়ান, সুইডিশ এবং চেকসহ মোট ষোলোটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯২৯ সালে 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট' প্রকাশের আগ পর্যন্ত 'ডাই ওয়াফেন নিডার' ছিল যুদ্ধ সম্পর্কিত জার্মান ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের গ্রন্থ। বের্টা ফন জুটনার একটি নন-ফিকশন বইয়ের পরিবর্তে উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে উপন্যাসের রূপটি ব্যাপকহারে পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে। বের্টা একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন- যার নাম ডাই ওয়াফেন নিডার। ডাই ওয়াফেন নিডার উপন্যাস অবলম্বনে ১৯১৪ সালে এবং ১৯৫২ সালে মোট দুটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছিল।

বের্টা তার বিখ্যাত উপন্যাস 'লে ডাউন ইয়োর আর্মস'-এর জন্যই ১৯০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। তিনি কেবল শান্তির কর্মীই ছিলেন না, তিনি উদার ধারণার চেতনা, উপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারী অধিকারের বিষয়েও সোচ্চার ছিলেন।

বের্টা ফন জুটনার ১৮৯১ সালে একটি শান্তিকামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত 'লে ডাউন ইয়োর আর্মস' উপন্যাস প্রকাশের পর বের্টা ফন জুটনার ধীরে ধীরে শান্তি আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ১৮৯২ থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শান্তিকামী সাময়িকীর সম্পাদক থাকাকালে বের্টা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। হেনরি থমাস বাকল, হার্বার্ট স্পেন্সার এবং চার্লস ডারউইনের রচনা তার শান্তিকামী চেতনাকে প্রভাবিত করেছিল। ধারণা করা হয় যে, আলফ্রেড নোবেল তার সমস্ত অর্থ যে সব পুরস্কারের জন্য উইল করে দিয়েছিলেন তার মধ্যে 'শান্তি পুরস্কার' সংযুক্ত করার পেছনে বের্টার এক বিশাল প্রভাব রয়েছে। বের্টা ফন জুটনার নিজে ১৯০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটি অর্জন করেছিলেন।

১৯০৪ সালে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে জনবহুল শহর বোস্টনে ইউনিভার্সাল পিস কংগ্রেসে অংশ নেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি সর্বদা প্রশংসিত ছিলেন।

১৯১৪ সালে বের্টা ফন জুটনারের বিখ্যাত উপন্যাস 'ডাই ওয়াফেন নিডার' চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়। নরডিস্ক ফিল্মস কোম্পানির বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক হোলগার মাডসেন এবং কার্ল থিওডর চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেন। ২০০৫ সালে জার্মানিতে বের্টা ফন জুটনারের স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়। অস্ট্রিয়ার ২ ইউরো মুদ্রায় জুটনারের ছবি চিত্রিত করা হয় এবং এর পূর্বে অস্ট্রীয় ১০০০ শিলিং ব্যাংকনোটেও তার ছবি চিত্রায়ণ করা হয়েছিল।

ইতোমধ্যে বের্টার শরীরে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বাঁধতে শুরু করে। তা সত্ত্বেও তিনি ১৯১৩ সালে হেগ আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। ১৯১৪ সালের আগস্টে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিতব্য ২১তম পিস কংগ্রেসের প্রস্তুতির সঙ্গেও জড়িত হন। ভিয়েনার শান্তি সম্মেলনটি বাস্তবে আর হয়ে ওঠেনি। ইউরোপকে ধ্বংসস্তূপ ও ছাইয়ের গাদায় রূপান্তরিত করার কারণ বলে চিহ্নিত দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের ফলে উনিশ শতকের মহান শান্তিবাদী আন্দোলনের তৎপরতা ও প্রত্যাশাসমূহের বিনাশ ঘটে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগেই ১৯১৪ সালের ২১ জুন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে ৭১ বছর বয়সে বের্টা ফন জুটনার মৃতু্যবরণ করেন। বের্টা তার বিখ্যাত উপন্যাস 'লে ডাউন ইয়োর আর্মস'-এর জন্যই ১৯০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। তিনি কেবল শান্তির কর্মীই ছিলেন না, তিনি উদার ধারণার চেতনা, উপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারী অধিকারের বিষয়েও সোচ্চার ছিলেন।

তিনি নারীর অধিকারের জন্যও লড়াই করেছিলেন এবং ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থা 'অস্ট্রিয়ান উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনস লীগ'-এ সক্রিয় ছিলেন, যেখানে তিনি শান্তি কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক শান্তি-আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বের্টাকে দেখতে যেতে হয়নি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। দশ মিলিয়ন সৈন্যের মৃতু্য এবং অজস্র মানুষের আজীবন পঙ্গুত্বও তাকে দেখতে হয়নি। শান্তির জন্য তার দীর্ঘদিনের অবিরাম লড়াই এই যুদ্ধের ফলে যেন অর্থহীন ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তবুও বিশ্ব মানবের শান্তি কামনায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে নেওয়া শান্তির শপথে বের্টা ছিলেন অবিচল। তার মতো পরিশ্রমী ও অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী হয়তো আর কখনোই পৃথিবীতে আসবে না। কিন্তু যে সুন্দর সমাজ ভাবনা ও শান্তিতে সহাবস্থানের স্বপ্নশিখা তিনি তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর কাছে, সেই শিখা আলোর মশাল হয়ে জ্বলতে থাকবে। এভাবেই বের্টা ফন জুটনারের চিন্তাধারা পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে