ব্রাজিল ফুটবল দল বিশ্বমানের, সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। দশকের পর দশক ধরে শৈল্পিক ফুটবল উপহার দিয়েছে দলটি। কিন্তু গত এক দশকে সেলেসাওরা সেই রঙ হারিয়েছে অনেকটাই। প্রীতি ম্যাচে পারফর্ম করলেও বড় আসরে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছে তারা। বিশ্বকাপ কিংবা কোপার মতো টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে কিংবদন্তি
পেলে-রোনালদোর উত্তরসূরিদের।
লাতিন আমেরিকার দেশটিতে প্রতিভার অভাব নেই সত্যি। কিন্তু বছরজুড়ে সেই প্রতিভা যেভাবে রপ্তানি করা হয়, তাতে নিজেদের ফুটবলের সৌন্দর্য হারাতে বসেছে সেলেসাওরা। আর তারই প্রতিফলন ঘটছে জাতীয় দলে। শৈল্পিক ফুটবলের ব্রাজিল রীতিমতো নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে। পেলে, কাফু, রোনালদিনহোদের উত্তরসূরিদের একের পর এক ব্যর্থতায় হৃদয় ভাঙছে দেশের মানুষ ও বিশ্বজুড়ে থাকা অগণিত ভক্তদের। ব্রাজিলের তরুণ প্রতিভাদের নিয়ে কিংবদন্তি মারিও জাগালো, গ্রাফিতেদের সেই শঙ্কায় আজ সত্যি হচ্ছে।
সবশেষ ২০০২ সালে বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছে ব্রাজিল। এরপর বিশ্ব আসরের মসনদে বসতে পারেনি তারা। শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পাওয়া তো দূরের কথা, শিরোপার মঞ্চেই উঠতে পারেনি পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। শিরোপার দাবিদার হিসেবে চলমান কোপায় অংশ নিয়েছিল ব্রাজিল। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে টাইকব্রেকারে (৪-২) হেরে বিদায় নিয়েছে সেলেসাওরা।
গত দুই দশকে অসংখ্য প্রতিভার জন্ম হয়েছে ফুটবলের 'উর্বর জমি' খ্যাত ব্রাজিলে। এর মধ্যে ফিলিপে কৌতিনহো, ফ্রেড, অস্কার, নেইমার থেকে গ্যাব্রিয়েল জেসুস, ভিনিসিউস, রদ্রিগো
ও এন্দ্রিকরা অন্যতম।
কোচদেও কোচ খ্যাত বিয়েলসা বলেন, 'একমাত্র এই ফুটবলের ভেতর গরীবরা কিছু পেত আগে; কিন্তু সেটি এখন আর নেই। কারণ ১৭ বছর বয়সী এনড্রিক, পালমেইরাস উইঙ্গার এস্তেভাও। কি লজ্জা! আমি আজকে এসব নিয়ে কিছু বললে আমার
সমালোচনাই করবে সবাই।'
সময়ের সঙ্গে পাড়ি দিয়ে নেইমার বড় তারকা হয়ে উঠলেও কৌতিনহো, অস্কাররা হারিয়ে গেছেন। ফ্রি স্টাইল ফুটবলের জন্য ইনজুরিতে মাঠের বাইরে থাকতে হচ্ছে নেইমার জুনিয়রকেও। তবে নিজেকে সেলেসাওদের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে ঠিকই বসিয়েছেন সাবেক এই বার্সা-পিএসজি তারকা।
বিশ্বসেরা দল ব্রাজিলের খেই হারানোর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে উঠতি তারকাদের ইউরোপের ক্লাবগুলোতে পাড়ি জমানোর প্রবণতা। যা তাদের সত্যিকারের বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার আগেই হাওয়া ভাসিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, সেরা প্রতিভাদের সারা বিশ্বে রপ্তানিও ব্রাজিল ফুটবলের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত মার্চে জার্মানির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে'কে ব্রাজিলের সাবেক স্ট্রাইকার গ্রাফিতে বলেছিলেন, 'যে সুন্দর খেলার জন্য ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলে প্রশংসিত হয়েছিলেন, সেটি
এখন আর স্বীকৃত নয়।'
তিনি আরও বলেছিলেন, 'এই ধরনের ফুটবল আর বিদ্যমান নেই।'
তরুণ প্রতিভাদের রপ্তানি নিয়ে ব্রাজিলের 'বুড়ো নেকড়ে' খ্যাত কোচ মারিও জাগালো শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, 'তরুণদের রপ্তানি দলের জন্য হুমকি। এর ফলে ব্রাজিল তাদের পরিচিতি
হারানোর শঙ্কায় পড়েছে।'
চলমান কোপায় উরুগুয়ের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে ভক্তদের উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখেছিলেন ব্রাজিল অধিনায়ক দানিলো।
দ্য পেস্নয়ার্স ট্রিবিউনে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে তারকাখ্যাতির মোহ নিয়ে তিনি লিখেছেন, 'মনে হচ্ছিল, একটা জায়গায় আটকে গেছি। ইচ্ছা হচ্ছিল, ব্রাজিলে ফিরে গিয়ে ফুটবল খেলা ছেড়ে দিই। সে সময় আসলে নিজেকে বায়ানিনহো, বায়ানোর (বাবাকে লোকে তা-ই ডাকে) সন্তান মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল শুধুই দানিলো, ৩১ মিলিয়ন ইউরোর খেলোয়াড়, সে সময় রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সবচেয়ে দামি ডিফেন্ডার। জার্নালে লিখেও ফেলেছিলাম: মনে হয় ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে। অথচ বয়স তখন মাত্র ২৪।'
এরপর তেতো সত্যা স্বীকার করে তিনি লিখেছেন, 'কয়েক মাস ভোগার পর একজন মনোবিদের সঙ্গে দেখা করলাম। তার কাছেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা পাওয়া, আবারও একজন শিশুর চোখে খেলাটাকে দেখ। শিশু বয়সে আপনি যখন ফুটবল খেলেন, তখন কিন্তু অত কিছু ভাবেন না। শরীর, মনের সামঞ্জস্য থাকে। সহজ কথায়, ভুলকে আপনি খুব একটা আমলে নেন না। শুধু খেলাটা উপভোগ করেন। সেই থেকে নিজেকে ৩১ মিলিয়ন ইউরোর
দানিলো ভাবা বন্ধ করে দিয়েছি।'
একই ভাবে ব্রাজিলের ঘরোয়া ক্লাব থেকে এখন স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের তারকা হয়ে উঠেছেন ভিনিসিউস জুনিয়র ও রদ্রিগো। ক্লাবের হয়ে আলো ছড়ালেও জাতীয় দলের
\হজার্সিতে নিজের ছায়া হয়ে থাকছেন ভিনি। তবে কালে
\হভদ্রে দলকে সাফল্য এনে দিচ্ছেন তারা।
তাদের পথেই পা বাড়িয়েছেন ব্রাজিলের আরেক তরুণ প্রতিভা এনদ্রিক। যাকে আগামীর পেলে হিসেবে ভাবা হচ্ছে। কিন্তু সেই এনদ্রিকও এরই মধ্যে ব্রাজিলের ঘরোয়া ক্লাব পালমেইরাস থেকে রিয়ালের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করেছেন। অপেক্ষা যৌবনের ১৮তে পা দেওয়ার। এরপরেই তিনি লস বস্ন্যাঙ্কোসদের হয়ে যাবেন।
ব্রাজিলের পালমেইরাসে খেলছেন আরেক বিস্ময়বালক ১৭ বছর বয়সি এস্তেভাও উইলিয়ান। এরই মধ্যে চড়ামূল্যে তাকে দলে ভিড়িয়েছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব চেলসি। তিনিও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার। এরপর ২০২৫ সালে বস্নুজদের ডেরায় পাড়ি দেবেন এই তরুণ প্রতিভা। গণমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী, ২০৩২ সাল পর্যন্ত ক্লাবটির হয়ে খেলবেন তিনি।
চলতি কোপায় ব্রাজিলের বিপক্ষে নামার আগে এনদ্রিক ও এস্তোভওকে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন উরুগুয়ের
\হআর্জেন্টাইন কোচ বিয়েলসা।