মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৬৭ জন নিহত এবং ১ হাজার ৯৯৯ জন আহত হয়েছে। এছাড়া মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এপ্রিলে ১১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। মে মাসের তথ্য এখনো প্রকাশিত না হলেও পূর্ববর্তী মাসগুলোর প্রবণতা বিবেচনায়, রাজনৈতিক সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।
অন্যদিকে দেশে ডাকাতি এবং ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, দেশব্যাপী ১৭১টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ১১৪টি ছিল। বিশেষ করে, ঢাকায় ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ২৪২টি ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল, যা ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মাসিক সংখ্যা। এছাড়াও, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে, ঢাকায় ১৫টি ডাকাতির ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
একই সময় দেশে মব জাস্টিসের ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গণপিটুনিতে অন্তত ১১৯ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৭৪ জন।
এমনেিক খোদ পুলিশই প্রায়ই মবের শিকার হচ্ছে। অভ্যুত্থানের ৯ মাস পরও পুলিশের বিরুদ্ধেই প্রতিদিন গড়ে একটার বেশি মব হচ্ছে। এপ্রিলে পুলিশের বিরুদ্ধেই ৩৭টি মব হয়েছে এবং মার্চে ৩৫টি। এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পুলিশ কোনো আসামি গ্রেপ্তারের পর একদল মানুষ সংগঠিত হয়েছে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বা পুলিশের উপর হামলা করে আসামি ছিনিয়ে নিতে চাইছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অপরাধের জোড়া আঘাতে গোটা দেশ এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাঁপছে। চরম নিরাপত্তাহীনতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় এরইমধ্যে অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়েছে। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সন্ধ্যার পর মানুষ ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছে। বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেও অনেকে আস্থাহীনতায় ভুগছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রæত উন্নতি না হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও এর বিরুপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
এদিকে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধিকে দায়ি করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর রাজনৈতিক পরিবর্তন অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতা দুর্বল করেছে। এছাড়া ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিদ্রোহের সময়, সারা দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে প্রায় ২ হাজার ২০০ বন্দী পালিয়ে গিয়েছিল। এদের ১ হাজার ৫০০ জনকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হলেও, প্রায় ৭০০ জন এখনও পলাতক, যার মধ্যে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অপরাধীও রয়েছে। এছাড়া সংগঠিত অপরাধ গোষ্ঠীর পুনরুত্থান এবং কিশোর গ্যাং সহ নতুন গ্যাং গঠন সহিংস অপরাধ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে উচ্চ যুব বেকারত্ব এবং আয়ের ব্যবধান বৃদ্ধি দুর্বল জনগোষ্ঠীকে অপরাধমূলক কর্মকাÐের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা এবং বিচারব্যবস্থার অকার্যকারিতা দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না। ক্রমাগত অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় ও মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি হওয়ার কারণেই পুলিশের ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এজন্য কাউকে ধরতে পারলে মানুষ নিজেরাই বিচার করার চেষ্টা করছে, যা মোটেও কাম্য হতে পারে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা অপরাধীদের সাহসী করে তুলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, যা অপরাধীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে।দেশের রাজনৈতিক বিভাজন ও দলীয় দ্ব›দ্ব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং সহিংসতা পরিস্থিতিকে আরও অবনতি করেছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার পেছনে কয়েকটি গভীর ও পারস্পরিকভাবে সম্পর্কযুক্ত কাঠামোগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে। সরকার পরিবর্তন, আন্দোলন,এবং সংঘর্ষজনিত পরিবেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিয়মিত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসহিষ্ণুতা এবং আন্দোলনে সহিংস উপাদান ব্যবহারের ফলে পুলিশকে পক্ষপাতদুষ্ট বা প্রতিপক্ষ মনে করা হচ্ছে, যা আস্থার সংকট তৈরি করছে।অন্যদিকে পুলিশ ও র্যাবসহ অন্যান্য সংস্থার একটি অংশ রাজনৈতিক নির্দেশে কাজ করে বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে। এছাড়া মামলার দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের মধ্যে দায়মুক্তির অনুভ‚তি তৈরি করছে। অর্থ বা প্রভাব খাটিয়ে অপরাধীরা মামলা থেকে পার পেয়ে যায়, যা সাধারণ মানুষকে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন করে তুলছে। সামগ্রিক ঘটনার উপসংহার হিসেবে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না, কারণ এটি শুধুই ‘পুলিশি’ সমস্যা নয়- এটি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা যা সমন্বিত ও আন্তরিক উদ্যোগ ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।