বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

নিষেধাজ্ঞার শেকল ভেঙে অসাধারণ অধিনায়ক

ক্রীড়া ডেস্ক
  ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নিষেধাজ্ঞার শেকল ভেঙে অসাধারণ অধিনায়ক
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নেতৃত্ব দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। ১৯৬৪ সালে তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয় -ওয়েবসাইট

ক্রিকেটের রাজকীয় সংস্করণ টেস্টের দ্বিপাক্ষিক লড়াইয়ে দেশ দুটির কিংবদন্তিদের নামেই হয়ে থাকে সিরিজের নামকরণ। ব্যতিক্রম শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজ। কেবল একজন ক্রিকেটারের নামেই ঐতিহ্যবাহী দ্বৈরথের নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৬০-৬১ মৌসুম থেকে সেই প্রচলনটা আজও অক্ষুণ্ন।

বিস্ময়কর হলেও সত্যি, সেই মহান ক্রিকেটার নিজের নামকরণের টেস্ট সিরিজে খেলেছিলেন। ক্রিকেটের বাইশ গজ থেকে বিদায় নেওয়ার আগেই বিরল সম্মানের অধিকারী ক্রিকেটার স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওরেল।

ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাদের প্রায় সবারই জানা ওরেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে ক্যারিবীয়রা ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকে বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। ওরেল, এভারটন ডি. উইকস ও ক্লাইড ডি.ওয়ালকট এই তিন ক্রিকেটার প্রতিপক্ষের জন্য হয়ে উঠেছিলেন ত্রাস। তাদের থ্রি ডবিস্নউ নামে অভিহিত করা হতো। ক্রিকেটে ইনিংসের মাঝামাঝি সময়ে সেরা জুটি হিসেবে তারা বিবেচিত হতেন।

বার্বাডোজের ব্রিজটাউনের সেন্ট মাইকেল এলাকায় অবস্থিত ব্যাংক হলে ১৯২৪ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন স্যার ফ্রাঙ্ক মর্টিমার ম্যাগলিন ওরেল। ডানহাতি ব্যাটার ও স্স্নো লেফট আর্ম অর্থোডক্স স্পিনের পাশপাশি বাঁহাতি মিডিয়াম পেস বোলিংটাও করতে পারতেন টাই ডাকনামের এ কিংবদন্তি।

১৯৫০-এর দশকে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। একমাত্র ব্যাটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দুইবার ৫০০ রানের জুটি গড়েছিলেন।

টেস্ট ক্রিকেটে ওরেলের পরিসংখ্যানটা ছিল সমৃদ্ধ। ৫১ টেস্টে ৪৯.৪৮ গড়ে ২২টি অর্ধশতক ও ৯টি শতকসহ করেছিলেন ৩,৮৬০ রান। ১৯৫০ সালের ইংল্যান্ড সফরটি ওরেলের জন্য ব্যক্তিগত অর্জনে পরিপূর্ণ ছিল। সেই সিরিজে ৮৯.৮৩ গড়ে তার ব্যাটে এসেছিল ৫৩৯ রান। সেই বছর ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে তিনি ক্যারিয়ার সেরা ২৬১ রানের ইনিংস খেলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজটি ৩-১ ব্যবধানে জিতে নেয়। ১৯৫১ সালের শুরুতে ওরেলকে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে মনোনীত করা হয়। ১৯৫০ সালের সাফল্যের প্রেক্ষিতে তাকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

টেস্ট আঙিনায় পা দেওয়ার আগেই ওরেল ব্যাট হাতে ছিলেন ভীষণ ধারাবাহিক। ১৯৪১-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বার্বাডোসের পক্ষে খেলেন। ১৯৪৩-৪৪ মৌসুমে ত্রিনিদাদের বিপক্ষে জন গডার্ডের সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে ৪০৪ মিনিট ক্রিজে থেকে ৫০২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েছিলেন।

১৯৪৮ সালে গাবি অ্যালেনের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক হয়। এ সিরিজ শেষে তিনি ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারে বসবাস শুরু করেন এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। পাশাপাশি সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ার লিগের্ যাডক্লিফের হয়ে খেলেন।

১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উদ্বোধনী ব্যাটার হিসেবে খেলতে নেমে ১৯১ রানে অপরাজিত থাকেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অল আউট হলেও ইতিহাসের প্রথম ক্যারিবীয় হিসেবে ক্যারিড দ্য ব্যাটের কীর্তি গড়েন।

১৯৬০ সালে তাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়। তার আগে কৃষ্ণাঙ্গ কোনো ক্রিকেটারের ক্যারিবীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বর্ণবৈষম্যের সেই ধারা ওরেলের নেতৃত্ব লাভের মধ্য দিয়ে ভেঙে যায়।

ক্রিকেটার তো বটেই, মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন ওরেল। ১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রম্নয়ারি সফরকারী ভারতীয় দলের অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টর আহত হন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলার চার্লি গ্রিফিথের বাউন্সারে তিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পান। এর ফলে তার খেলোয়াড়ি জীবনের সমাপ্তি ঘটে। দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ফ্রাঙ্ক ওরেল আহত নরি কন্ট্রাক্টরের জীবন বাঁচাতে রক্ত দান করেন। কন্ট্রাক্টরকে বাঁচাতে তার অবদানের কথা স্মরণ করে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল প্রতি বছর ৩ ফেব্রম্নয়ারি রক্ত সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ ছাড়া দিনটিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে 'স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল দিবস' পালিত হয়।

১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ৫ টেস্ট সিরিজের পর পেশাদার ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ফাঙ্ক ওরেল। সেই বছর ক্যারিবীয় সাংবাদিক আর্নেস্ট আইটল তার আত্মজীবনী লেখেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি জামাইকার সিনেট সদস্য ছিলেন। ক্রিকেটে মূল্যবান অবদান রাখার জন্য ১৯৬৪ সালে তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৬৬-৬৭ মৌসুমে শীতকালে দলের সঙ্গে ওরেল ভারত সফরে যান। ভারতে অবস্থানকালেই তার শরীরে লিউকেমিয়া (বস্ন্যাড ক্যান্সার) ধরা পড়ে। জামাইকায় ফিরে আসার এক মাস পর ১৯৬৭ সালের ১৩ মার্চ কিংস্টনে ফ্রাঙ্ক ওরেলের মারা যান। তার মৃতু্যর পর ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার শহরের অ্যাংলিকান চার্চ ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে তার সম্মানে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। কোনো ক্রীড়াবিদের সম্মানে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে এটিই ছিল প্রথম স্মরণসভার আয়োজন। ১৯৮৮ সালের জুনে তার ছবি সংবলিত ২ ডলার মূল্যমানের বার্বাডিয়ান স্ট্যাম্প অবমুক্ত করা হয়।

২০০৭ সালে ওরেলের মৃতু্যর ৪০তম বার্ষিকীতে স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল মেমোরিয়াল কমিটি গঠিত হয়। ওইদিনই ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তান মুখোমুখি হয়। ২০০৯ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোয় স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল মেমোরিয়াল বস্নাড ড্রাইভ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ৭৪ বছর বয়সি নরি কন্ট্রাক্টর এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিলেন।

আইসিসি ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন (ফিকা) যৌথভাবে ২০০৯ সালে চালু করে হল অব ফেম। ক্রিকেটে অবিস্মরণীয় অবদান রাখা খেলোয়াড়দের এই তালিকায় রাখা হয়। ২০০৯ সালে হল অব ফেমের উদ্বোধনের সময় ৫৫ ক্রিকেটার তালিকায় স্থান পান, যাদের মধ্যে ওরেলের নামটা অবধারিতভাবেই ছিল। বার্বাডোজের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেভ হিল ক্যাম্পাসে অবস্থিত একটি আবাসিক ছাত্রাবাস তার সম্মানে রাখা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে