ভারতীয় সিনেমার অন্যতম উজ্জ্বল একটি নাম তনুজা মুখার্জি। তিনি একজন বহুমুখী ভারতীয় অভিনেত্রী। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ভারতীয় চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন; সক্রিয় ছিলেন ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। অনেক বিরতির পর ২০০২ সালে তিনি আবার কাজ শুরু করেন। ভিলা থেরেসারে একটি কিন্ডারগার্টেন থেকে পড়াশোনা শুরু করলেও পড়াশোনা প্রতি আগ্রহ ছিল কম। তাই অভিনয় জগতের মনোনিবেশ করেন। তার সুন্দরী মায়ের সাজসজ্জা খুব ভালো লাগত। বড় বোন নূতনের সঙ্গে 'হামারি বেটি' (১৯৫০) ছবিতে ' বেবি তনুজা' নামে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। 'ছাবিলি' (১৯৬০) চলচ্চিত্রের তিনি মূল নায়িকা হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। ছবিটির পরিচালক ছিলেন তার মা শোভনা। তিনি কিদার শর্মার 'হামারি ইয়াদ আয়েগি' (১৯৬১) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে খ্যাতির শিখরে পৌঁছান।
উত্তমকুমার মানেই ক্যারিশমা, সেই ভুবন ভোলানো হাসি, সেই প্রেমিক রূপ। এবার নাকি তিনি গায়কের ভূমিকায়। সঙ্গীতের দায়িত্বে স্বয়ং শ্যামল মিত্র; ছবির প্রযোজকও তিনি। প্রশান্ত কুমার রায় ওরফে অভিজিৎ চৌধুরী ওরফে 'হৃদয় হরণ'-এর গলা বেজে উঠবে তারই সুরে। আর বিপরীতে? এখানেই চমক লাগল দর্শকের। 'সুচরিতা'র চরিত্রে যিনি অভিনয় করবেন, তিনি নাকি বাঙালি নন! উত্তমের বিপরীতে অভিনয় করবেন, অথচ বাংলাটাই বলতে পারবেন না! কিন্তু পর্দায় চোখ রাখতেই বাঙালি অবাক। শুনে তো মনে হচ্ছে না ইনি অবাঙালি! তাহলে বোধ হয় ডাবিং করিয়েছেন। খবর হলো, কাউকে দিয়ে নয়; নিজেই নিজের ডাবিং করেছেন তনুজা। ব্যস, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বলিউড তো বটেই, বাংলার আপামর দর্শকের কাছে তিনি হয়ে গেলেন 'তনুজা'। সুপারহিট হলো উত্তম তনুজার 'দেয়া নেয়া' ছবি। নিজের প্রথম বাংলা ছবি 'দেয়া নেয়া'তেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, থাকতেই এসেছেন।
তনুজা'র মা শোভনা সামারথ ছিলেন চলিস্নশের দশকের অন্যতম অভিনেত্রী। বাবা কুমারসেন সামারথও ছিলেন পরিচালক। এই ধারারই পরবর্তী বাহক হলেন তনুজা। অবশ্য তিনি একা নন; বড়ো দিদি নূতনও ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে জায়গা পেয়েছেন।
শুধু কি বাংলা সিনেমা? 'জুয়েল থিফ', 'বাহারে ফির ভি আয়েঙ্গি', 'অনুভব', 'হাথি মেরে সাথী', 'মেরে জীবন সাথী'- তালিকাটা অনেক বড়। দেব আনন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চনের নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন তিনি। কিন্তু নিজের জায়গাটুকু ধরে রেখেছেন প্রবলভাবে। তার লক্ষ্য ছিল একটাই, রূপে নয়, নায়িকা হিসেবেও নয়; বরং একজন ভালো অভিনেত্রী হিসেবে জায়গা পেতে চান। অভিনয়টা ভালো করে করতে চান। সেই জায়গায় কোনোদিনও ফাঁকি দেননি তনুজা। সমু মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেছেন; একটা সময় দুজনে আলাদাও থেকেছেন। কিন্তু জীবনের কাছে হার মানেননি তনুজা। নতুন কিছু শেখার ইচ্ছা তার যে ছিল প্রবল। জীবনের কাছে তিনি আজীবন একজন ছাত্রী হয়েই থেকেছেন। বাঙালি পরিবারে জন্মাননি, আশপাশে সেরকম পরিবেশও পাননি; সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গা থেকে এসে বাংলা ভাষাটাকে ভালোবেসেছিলেন। নিজেই শিখেছিলেন। নতুন নতুন ভাষা শিখতে কখনো ক্লান্তি নেই তার।
তিনি মনে করেন, বাংলা চলচ্চিত্র তাকে অন্য একটা মাত্রা দিয়েছেন এবং সেটাতে তিনি আত্মতৃপ্তি পেতেন। বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি উত্তমকুমারের বিপরীতে কেবল 'দেয়া নেয়া' (১৯৬৩) ছবিতে অভিনয় করেননি, 'অ্যান্টনি-ফিরিঙ্গি' (১৯৬৭), 'রাজকুমারী'ও (১৯৭০) অন্যতম। উত্তমকুমার ছাড়াও তিনি সৌমিত্র চ্যাটার্জির বিপরীতে কয়েকটি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। 'তিন ভুবনের পাড়ে' (১৯৬৯) ও 'প্রথম কদম ফুল' অন্যতম। অনেক দিন বিরতির পর তিনি 'সাথিয়া' (২০০২), 'রুলস' (২০০৩), 'খাকি' (২০০৪) ও 'সন অব সরদার'সহ আরও কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি আর গুজরাটি ছবিতে কাজ করে এই অভিনেত্রী পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা।
মেয়ে কাজল বলিউডের অন্যতম নামিদামি অভিনেত্রী। কিন্তু সেই পরিচয়ে ঢাকা পড়ে যায়নি তনুজার নিজস্ব শৈলী। সেই সিনেমাই তাকে এনে দিয়েছে 'ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট' সম্মান। যেখানে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন, সবটুকু দিয়ে দিয়েছেন। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা গেছে 'সোনার পাহাড়'-এ। ২০১৮ সালে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবির হাত ধরেই বাংলা সিনেমার জগৎ ফিরে পেয়েছিল তার 'নন্দিনী'কে। এখনো সেই ঝলক, সেই ব্যক্তিত্ব, তেমনই অভিনয়। সঙ্গে আবারও মুখোমুখি সৌমিত্র-তনুজা। যিনি আজও ভালোবাসেন নিজের লাইব্রেরি ঘরটিকে। এত বর্ণময় জীবন, কখনো ইচ্ছা করে না নিজের জীবনী লিখতে? একটু হাসেন 'নন্দিনী'। কিংবা হয়ত বিরক্তও হন। বলেন, এত ইন্টারভিউ দিয়েছি, আবার আত্মজীবনীর কী প্রয়োজন? জীবনকে লেখা অত সহজ নাকি! সেই জীবনের সাঁকোয় দাঁড়িয়ে তনুজা আজও কিংবদন্তি আজও অমলিন তার হাসিটি।