সোমবার, ২৬ মে ২০২৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

উজ্জ্বল নক্ষত্র আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

১৯৭১ সাল, দেশজুড়ে শুরু হলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মাধ্যমিক পড়ুয়া আহমেদ ইমতিয়াজের বয়স ছিল তখন মাত্র পনের বছর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বড় ভাই টুলটুল যুদ্ধে যোগদান করেন। তখন থেকেই তিনি যেন নিজেকে আর ঘরে বেঁধে রাখতে পারছিলেন না। দেশ মা'কে রক্ষা করার জন্য মায়ের অনুমতি নিয়ে বন্ধু মানিক ও মাহবুবের সঙ্গে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুনরায় সঙ্গীতে মেতে ওঠেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
তারার মেলা ডেস্ক
  ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
উজ্জ্বল নক্ষত্র আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
উজ্জ্বল নক্ষত্র আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

বাংলা সঙ্গীত জগতে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধার এক নাম আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছে, তেমনি বাংলা চলচ্চিত্রকে করেছে সমৃদ্ধ। সঙ্গীতের প্রায় সব শাখায় অবদান রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধা এই বরেণ্য সুরকারের গতকাল ছিল জন্মদিন। ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে জন্ম এই প্রবাদ পুরুষের। বাবার সঙ্গে বাড়িতে বসে রেডিও শোনা ছিল তার নিত্যদিনের দিনলিপি। গান শুনতে শুনতে গান গাওয়ার চেষ্টারও শুরু। গিটার কেনার মাধ্যমে প্রথম বাদ্যযন্ত্র হাতে তুলে নিলেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার ছিল না। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি খুব ভালোবাসতেন তিনি। প্রকৃতিই যেন তার সবচেয়ে বড় শিক্ষাগুরু। নিজে নিজেই শিখে ফেলেছিলেন গিটার, পিয়ানো ও হারমোনিয়াম। মাত্র তেরো বছর বয়সেই তৈরি করেছিলেন জীবনের প্রথম গান- 'ও মন ময়না, আয় ফিরে আয় নাৎ'। নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন মিলে নিজেদের একটি দল গঠন করে পাড়া মাতিয়ে রাখতেন তখন। কিন্তু হাসিখুশি মাখা শৈশবের দিনগুলো খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি বুলবুলের।

এলো ১৯৭১ সাল, দেশজুড়ে শুরু হলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মাধ্যমিক পড়ুয়া আহমেদ ইমতিয়াজের বয়স ছিল তখন মাত্র পনের বছর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বড় ভাই টুলটুল যুদ্ধে যোগদান করেন। তখন থেকেই তিনি যেন নিজেকে আর ঘরে বেঁধে রাখতে পারছিলেন না। দেশ মা'কে রক্ষা করার জন্য মায়ের অনুমতি নিয়ে বন্ধু মানিক ও মাহবুবের সঙ্গে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুনরায় সঙ্গীতে মেতে ওঠেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। 'আফটার মেথ' নামে একটি গানের দল তৈরি করেন। ১৯৭৬ সালে বিটিভির জন্য গান করার সৌভাগ্য হয় তার। তখন মনে শুধু দেশের কথা, দেশের সুর। তাই প্রতিটি গানই ছুঁয়ে যেত দেশপ্রেমের মায়া। মুক্তিযুদ্ধের সব অভিজ্ঞতা যেন তার লেখা আর সুরে প্রতিফলিত হয়ে আসতে থাকে। পরবর্তী সাত বছর ধরে শুধু দেশাত্মবোধক গানই তৈরি করে চলেন তিনি। তারপর শুরু হয় তার চলচ্চিত্রে গান করা। নাগরদোলা ছবির জন্য 'ও আমার মন কান্দে' গানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রাঙ্গনে পদার্পণ হয় তার। ১৯৭৮ সালে 'মেঘ বিজলি বাদল' ছবিতে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান তিনি।

1

তবে সবার সুনজরে পড়েন 'নয়নের আলো' সিনেমাটিতে সুর করার মাধ্যমে। 'নয়নের আলো' সিনেমাটির সুর করা প্রায় প্রত্যেকটি গানই সেই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই চলচ্চিত্রের পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পরবর্তী সময়ে প্রায় কয়েকশ' চলচ্চিত্রে সুর ও সঙ্গীতের কাজ করেছেন তিনি। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি অনেক শিল্পীর জন্য ব্যক্তিগত অ্যালবামেও কাজ করেছেন। তার উলেস্নখযোগ্য কিছু গানের মধ্যে রয়েছে 'মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে', 'সেই রেললাইনের মেঠো পথ', 'সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য', 'আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি', 'আমার বুকের মধ্যেখানে', 'আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন', 'আমি তোমারি প্রেম ভিখারি', 'আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে', 'তোমায় দেখলে মনে হয়', 'আম্মাজান আম্মাজান', 'তুমি মোর জীবনের ভাবনা' 'তুমি আমার এমনই একজন', 'একাত্তরের মা জননী' 'একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না', 'পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি', 'তোমায় দেখলে মনে হয়', 'বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম' 'যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে', 'প্রাণের চেয়ে প্রিয়', 'অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে', 'ঘুমিয়ে থাকো গো সজনী', 'তুমি মোর জীবনের ভাবনা' চিঠি লিখেছে বউ আমারসহ অসংখ্য গান। এসব গানের তালিকা সহজেই শেষ হওয়ার নয়। 'প্রেমের তাজমহল' সিনেমার জন্য তিনি ২০০১ সালে এবং 'হাজার বছর ধরে' সিনেমার জন্য ২০০৫ সালে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।

দেশের সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১০ সালে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি দেশের অনেক শিল্পী নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করেছিলেন বুলবুল। তার কথা আর সুরে সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনক চাঁপা, ন্যান্সি, কনাসহ দেশের অনেক জনপ্রিয় শিল্পী গান গেয়েছেন। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে জীবনের ওপারে চলে যান কিংবদন্তি এ সঙ্গীত সাধক। তার গানের মাধ্যমেই শ্রোতা-দর্শকের মনে আজীবন স্থায়ী হয়ে থাকবেন তিনি। বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।

তবে তিনি যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবেন- বিষয়টি হয়তো আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। আর এ কারণেই বুঝি ফেসবুকের শেষ স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, 'আমাকে যেন ভুলে না যাও, তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।' হয়তো তার মনের নিভৃত কোণে জমানো ছিল হাজারো ক্ষোভ, অভিমান, কিংবা না পাওয়ার বেদনা অথবা ভাই হারানোর কষ্ট। তিনি হয়তো তখনো জানতেন না, কোটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রইবে তার নামটি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নামটির সঙ্গে মিশে আছে কথা, সুর, দেশ, মুক্তি, ভালোবাসা আর বুক ভরা ক্রন্দন। আমাদের সঙ্গীত জগতে কথা ও সুরের ঐশ্বর্যে প্রতিভাবান এক সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব তিনি। একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকসহ অনেক গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিটি মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। তার এই চলে যাওয়া সঙ্গীত জগতে তাই শুধু ক্ষতের সৃষ্টিই করেনি, তৈরি করেছে এক বিশাল শূন্যস্থান, যা সত্যিই অপূরণীয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে