দেশের ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় এক নাম গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী নকীব খান। গানের সঙ্গে তার সম্পর্ক এক দুই বছরের নয়। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি। নিজের 'মন শুধু মন ছুঁয়েছে', আইয়ুব বাচ্চুর 'এখন অনেক রাত', নিজের 'ভালো লাগে জ্যোৎস্না রাতে', কুমার বিশ্বজিতের 'তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে'সহ বেশ কিছু কালজয়ী গানের সুরকার তিনি। সঙ্গীতের সঙ্গে তার দীর্ঘ এই জার্নি নিয়ে এবার একক একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। যার শিরোনাম 'সুরে সুরে পঞ্চাশে' উদযাপন করা হবে।
আগামী ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ইয়ামাহা ফ্ল্যাগশিপ সেন্টারে এই কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে নকীব খান নিজের গানের পাশাপাশি তার করা সুরের গানগুলো গেয়ে শোনাবেন। আগত শ্রোতাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবেন গানের পেছনের গল্পসহ নানা ঘটনা- যা নিয়ে এই কিংবদন্তি বলেন, 'সঙ্গীতের সঙ্গে আমার ৫০ বছরের বেশি সময় থেকে সম্পর্ক। ছোটবেলা থেকেই গান-মিউজিকের সঙ্গে আছি। আমার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আগামী ১৭ জানুয়ারি 'সুরে সুরে পঞ্চাশে' শিরোনামে একটি একক কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। আমি আসছি আপনাদের গান শোনাতে, গানের পেছনের গল্প শোনাতে। আশা করি, সবার সঙ্গে সুন্দর একটি সময় কাটবে। দীর্ঘ এই জার্নি আপনাদের জন্যই করতে পেরেছি। সবাইকে অসম্ভব ভালোবাসা। এদিন সবাই আসুন দেখা হবে, গান হবে, আড্ডা হবে।'
নকীব খানের একক এই কনসার্টটি আয়োজন করছে নুর'স ইভেন্টস। যার টিকিট এরই মধ্যে বিক্রি শুরু হয়েছে। অনলাইনে ১২০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে এর টিকিট। আয়োজনটি শুরু হবে শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টায় আর শেষ হবে রাত ৯টায়। নকীব খান কৈশোরেই ব্যান্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী নকীব ১৯৫৩ সালে চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কিশোর বয়সেই ব্যান্ডসঙ্গীতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন নকীব খান। এ দেশের ব্যান্ড সঙ্গীতকে যারা জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে এসেছেন তাদের অন্যতম নকীব খান। বহুমাত্রিক এ শিল্পী একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং নন্দিত ভোকাল। বাবা আইয়ুব খানের মেঝো ছেলে নকীব খান কৈশোরেই ব্যান্ড সঙ্গীতের সাথে জড়িয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি ইউনিয়নে জন্ম নেয়া নকীব খানের ব্যান্ডসঙ্গীতের ভোকাল হওয়া কম কথা নয়। কারণ, চুনতি ইউনিয়ন এমনিতেই রক্ষণশীল এলাকা হিসেবে পরিচিত। সেরকম অঞ্চলে তার বড় ভাই সুরকার ও গীতিকার জালাল উদ্দিন খান জিলস্নু এবং ছোট ভাই শাহবাজ খান পিলু ড্রামার, ভোকালিস্ট ও গীতিকার- এরকম সাংস্কৃতিক পরিবার থেকে আসা নকীব খানের 'বালার্ক' নামের ব্যান্ডের গায়ক ও পিয়ানোবাদক হিসেবে সঙ্গীতাঙ্গনে আত্মপ্রকাশ ঘটা বেশ বিস্ময়েরই।
সেই 'বালার্ক' থেকে এরপর যোগ দেন সোলস-এ। 'সোলস' হলো স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে সাহেদ উল-আলমের নেতৃত্বে নতুন স্বপ্নে বিভোর কিছু তরুণের সমন্বয়ে গঠিত সুরেলা নামের একটি অর্কেস্ট্রা দল। ১৯৭৪ সালে যার নাম পরিবর্তিত করে সোলস রাখা হয়। ওই বছরই 'সোলস' এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যুক্ত হন নকীব খান। শিল্পী তপন চৌধুরী ও আহমেদ নেওয়াজের পর 'সোলস' এ যোগ দেওয়া নকীব খান তাতে একটানা ১০ বছর কাটিয়ে দেন। সোলস-এ যোগদানের পর থেকেই মূলত নিজেদের সুর ও কথায় গান কম্পোজ শুরু হয় এবং বাংলাদেশের ব্যান্ডে নতুন স্বর হয়ে ওঠে 'সোলস'। একটা নতুন ভাষাও পায় 'সোলস'। রাতারাতি নাম ছড়িয়ে পড়া সোলস-এর বেশ কিছু কালজয়ী গানের গীতিকার ও সুরকার নকীব খান।
বাবা মারা যাওয়ার পর ব্যক্তিগত কারণে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন নকীব খান এবং গড়ে তোলেন নিজের ব্যান্ড রেনেসাঁ। প্রায় তিন বছর পর দলটির প্রথম অ্যালবাম 'রেনেসাঁ' বাজারে আসে। ১৯৯৩ সালে 'তৃতীয় বিশ্ব' নামে দ্বিতীয়, ১৯৯৮ সালে '৭১-এর রেনেসাঁ' নামে তৃতীয় এবং ২০০৪ সালে 'একুশ শতকের রেনেসা' নামে চতুর্থ অ্যালবাম বাজারে আসে।
বেশ কিছু গানের কালজয়ী সুরকার হলেও নকীব খানকে ঢাকাই সিনেমার নির্মাতারা ব্যবহারের সুযোগ পাননি। ফলে, দর্শকরাও তার পরিচালনায় ভালো ভালো সুরের পেস্ন-ব্যাক থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। তবে করোনার আগে প্রথমবারের মতো একটি সিনেমার তিন/চারটি পেস্ন-ব্যাকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। কৌশিক সংকর দাস পরিচালিত সিনেমাটির নাম 'পাঞ্চ'।
শ্রোতাপ্রিয় সঙ্গীতের মানুষের পাশাপাশি একজন করপোরেট ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সমাদৃত নকীব খান। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি চাকরি করেছেন বেশ কিছু বহুজাতিক ও দেশি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে। ১৯৯৩ সালে নুসরাত খানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন নকীব খান। বর্তমানে তিনি এক কন্যা ও পুত্রসন্তানের জনক।