বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মালদ্বীপ হয়ে পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশের

রাজস্ব হারানোয় উদ্বেগে ভারত

আগে বাংলাদেশের পণ্য ভারতীয় বিমানবন্দরের মাধ্যমে পরিবহণ হতো। কিন্তু এখন তারা অন্য রুটে তাদের পণ্য পরিবহণ করছে। ফলে আগে এসব পণ্যের কার্গো থেকে ভারত যে রাজস্ব পেত সেটি এখন পাচ্ছে না
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক
  ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রাজস্ব হারানোয় উদ্বেগে ভারত

ভারতের বিমানবন্দর ও নৌবন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি না করে, তার পরিবর্তে মালদ্বীপের মাধ্যমে পোশাক পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারকের এ পদক্ষেপে ভারতের বিমান ও নৌবন্দরগুলো বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। ২ নভেম্বর ভারতীয় গণমাধ্যম লাইভমিন্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গণ-অভু্যত্থানে হাসিনা সরকার পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েনের মধ্যে এ সংবাদ জানা গেল।

লাইভমিন্টকে এমএসসি এজেন্সি (ইন্ডিয়া) প্রাইভেট লিমিটেডের মহাপরিচালক দীপক তিওয়ারি বলেছেন, 'আগে বাংলাদেশের পণ্য ভারতীয় বিমানবন্দরের মাধ্যমে পরিবহণ হতো। কিন্তু এখন তারা অন্য রুটে তাদের পণ্য পরিবহণ করছে। ফলে আগে এসব পণ্যের কার্গো থেকে ভারত যে রাজস্ব পেত সেটি এখন পাচ্ছে না।' মেডিটেরিনিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি) বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কার্গো পরিবহণ সংস্থা। এ খাতের সংশ্লিষ্ট তিন ভারতীয় কর্মকর্তা জানান, মালদ্বীপে সমুদ্রপথে পোশাক পণ্য পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ, সেখান থেকে তা এয়ার কার্গোতে করে এইচঅ্যান্ডএম-সহ বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে।

তারা বলেছেন, রপ্তানির এই বিকল্প রুটের কারণে ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দুর্বল হতে পারে এবং পণ্য পরিবহণ ও অবকাঠামো প্রকল্পগুলোয় দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সুযোগও হ্রাস পাবে।

বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মাধ্যমে পোশাক পণ্য রপ্তানি করায়- দেশটির সরকার ট্রানজিট ফি ও বন্দরের শুল্ক বাবদ যে বিপুল আয় করত, পণ্য পরিবহণের ব্যবসাও হতো লাভবান, এখন এই আয়ে ভাটা পড়বে আশঙ্কা তাদের। একজন কর্মকর্তা লাইভমিন্টকে বলেন, 'এই পরিস্থিতিতে, ভারত সরকার একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজছে যা ভারত হয়ে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির বিষয়টি নিশ্চিত করবে এবং ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে।'

অপর এক কর্মকর্তা বলেন, 'বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত এসব পোশাক পণ্যের একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ ভারতীয় অবকাঠামো বা কারখানায় উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় কোম্পানিগুলোই এসব কারখানা পরিচালনা করে। এই বিষয়টি (ভারত) সরকারের নজরে রয়েছে। ভারতের ওপর এটির প্রভাব কেমন হতে পারে এখন আমরা সেটি নিরূপণের চেষ্টা করছি।'

এদিকে বাংলাদেশের মোট রপ্তানিতে ৮০ শতাংশ অবদান রাখে পোশাকশিল্প। তাই সরবরাহ শৃঙ্খলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখাই বাংলাদেশের উদ্দেশ্য। তবে একজন শিল্প বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভারতের বিমানবন্দরগুলো পোশাকের চালান রপ্তানির ক্ষেত্রে যে বিলম্ব হয় তা এড়িয়ে নির্ধারিত ডেডলাইনের মধ্যেই ক্রেতার কাছে তা পৌঁছানো এবং সরবরাহ চক্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও সুসংহত করতেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা। ভারতের ওপর কোনো রাগ বা বিরাগ থেকে বাংলাদেশ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করেন না তিনি।

অরুণ কুমার নামের এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, 'রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন রুটের মাধ্যমে কৌশলগত সুবিধা, সঙ্গে নিশ্চিত নির্ভরযোগ্যতা পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পোশাক বাজারের কঠোর সময়সীমা পূরণের ক্ষেত্রে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ভারতের বন্দরের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে বাংলাদেশ তাদের সাপস্নাই চেইনের (সরবরাহ শৃঙ্খলের) ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে।'

অরুণ কুমার অ্যাসোসিয়েশন অব মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট অপারেটর্স অব ইন্ডিয়ার সভাপতি। এটি সমুদ্র, রেল ও সড়কপথে নির্বিঘ্ন পরিবহণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করা পরিবহণশিল্প মালিকদের একটি সংগঠন।

আরও ব্যাখ্যা করে অরুণ কুমার বলেন, পোশাক পণ্যকে পচনশীল পণ্য হিসেবে ধরা হয়। ফলে সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে এ ধরনের পণ্যের চালান বাতিল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া, পোশাক উৎপাদন করা হয়, নির্দিষ্ট একটি মওসুমের আবহাওয়া ও হাল-ফ্যাশন অনুযায়ী, সময়মতো চালান না গেলে চালানের মূল্যও হারায়।

ভারতের পোশাক রপ্তানিকারকরা অবশ্য এক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তারা বলেছেন, বাংলাদেশের তার রপ্তানির রুট পরিবর্তন করলে ভারতের তেমন ক্ষতি হবে না।

ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য (পূর্বাঞ্চল) অনীল বুচাসিয়া টেলিফোনে লাইভমিন্টকে বলেন, 'এ নিয়ে তেমন উদ্বেগের কিছু দেখি না। ভারতের বিমানবন্দরগুলোয় এর মধ্যেই অনেক জট। তাই আমরাই ভারত সরকারকে বাংলাদেশের পোশাক ভারতীয় বিমানবন্দরগুলোর মাধ্যমে রপ্তানি বন্ধ করতে অনুরোধ জানিয়েছি।'

আরেকজন কর্মকর্তা দাবি করেন, গত আগস্টে হাসিনা সরকার পতনের সঙ্গে বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই। শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। গত মাস অক্টোবরে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

তিনি বলেন, 'হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বাংলাদেশ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করে না ভারত সরকার। পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড, সুতরাং এই রপ্তানি চাঙা করতে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।'

চলতি ২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমেছে। এই অর্থবছরে এই খাত থেকে ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমায় রপ্তানি আয়ও কমেছে। তবে ২০২৩ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ১৭ শতাংশ বেড়ে ৪৬ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছিল। যা ২০২২ অর্থবছরে ছিল ৩৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। গত বছর বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা অর্জন করে। বাংলাদেশের আগে কেবল ছিল চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সব মিলিয়ে গত বছর বাংলাদেশ যত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছিল তার ৮০ শতাংশই এসেছিল তৈরি পোশাক খাত থেকে। অপরদিকে ভারতের তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।

এদিকে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূতের কাছে ইমেইল পাঠিয়েছিল লাইভমিন্ট। তবে প্রতিবেদন প্রকাশের সময় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে