ভোট গ্রহনের দিন-ক্ষণ ঠিক না হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে তৎপর হয়ে উঠেছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতা। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের তৎপরতা এখন সরগরম এ আসন।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকেই তাদের পারস্পরিক প্রতিদ্ব›িদ্বতায় এখানে দলের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। কর্মী, সমর্থক আর অনুসারীদের নিয়ে দলীয় কর্মসূচিতে তো রয়েছেনই; বাড়িয়েছেন দলীয় ও সাংগঠনিক কর্মকাÐের পরিধিও। সেই সঙ্গে শীতবস্ত্র বিতরণ, ক্রীড়া অনুষ্ঠান, ইসলামি জলসাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও সরব তারা। বিএনপির অনেকেই কেন্দ্র থেকেও নেতা নিয়ে এনে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে।
শুধু বাগমারা উপজেলা নিয়েই গঠিত রাজশাহী-৪ আসন। এ আসনে রয়েছে ১৬টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভা। ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনটিতে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত সরদার আমজাদ হোসেন। ১৯৯৬ ও ২০০১-এ বিএনপি প্রার্থী সাবেক সচিব প্রয়াত আবু হেনা জয়লাভ করেন। ২০০৮-এ আওয়ামী লীগের প্রার্থী শিল্পপতি প্রকৌশলী এনামুল হক এমপি নির্বাচিত হন। তিনি টানা তিনবার এমপি ছিলেন। ২০২৪-এ আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরিবর্তন করে আবুল কালাম আজাদকে মনোনয়ন দেয়। তিনি এমপি নির্বাচিত হন।
এনামুল ও আবুল কালাম বিভিন্ন মামলার আসামি হিসাবে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। দলটির নেতাকর্মীদের কোনো তৎপরতা নেই। তবে তৎপর রয়েছে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা।
এবার এ আসনটিতে বিএনপির মনোনয়নপ্রতাশীদের মধ্যে রয়েছেন, বাগমারা উপজেলা বিএনপির আহŸায়ক ডিএম জিয়াউর রহমান জিয়া, সদস্য সচিব অধ্যাপক কামাল হোসেন, সাবেক ছাত্রদল নেতা আমেরিকা প্রবাসী ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম, রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য সচিব রেজাউল করিম টুটুল, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক সহসম্পাদক ড্যাব নেতা ডা. আশফাকুর রহমান শেলী।
বিএনপির এই ছয় নেতা ছাড়াও জামায়াত নেতা ডা. আব্দুল বারি সরদার ও উপজেলা জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাসির উদ্দিনও রয়েছেন মাঠে। তারাও বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন।
স্থানীয় সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেই বাগমারা বিএনপির নেতাকর্মীদের একটি অংশ দখলবাজিতে নেমেছে। উপজেলাজুড়ে চলছে পুকুর, খাল, বিল দখলের ‘মহোৎসব’। থেমে নেই জমি দখলও। স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে কৃষি জমি নষ্ট করে অবাধে চলছে পুকুর খনন। চলছে চাঁদাবাজিও। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদও দখলের চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দু-একজন পতিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি অংশ তাদের সঙ্গে মিশে গেছেন। তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের অর্থ। তাদের অনেকেই এখন নিজেদের বিএনপি কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছেন। এ নিয়ে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
ডিএম জিয়াউর রহমান বাগমারা উপজেলা বিএনপির আহŸায়ক। এর আগে তিনি উপজেলা বিএনপির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আউসপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাগমারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। ৫ আগস্টের পর তিনি জোরালোভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
জিয়াউর রহমান বলেন, বাগমারায় বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। দলকে তৃণমূল পর্যায়ে আরও সুসংগঠিত করতে আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করছি। নেতাকর্মীদের দুঃসময়ে পাশে থেকেছি। আমি দীর্ঘ সময় জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছি। এসব বিষয় বিবেচনায় হাইকমান্ড আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে আশাবাদী।
অধ্যাপক কামাল হোসেন বাগমারা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব। ১৯৯৪ সালে ভবানীগঞ্জ কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন তিনি। ২০১০-এ বাগমারা উপজেলা যুবদলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৬-তে রাজশাহী জেলা যুবদলের এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক হন। ২০১৭-তে জেলা বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক হন। কামাল হোসেন ভবানীগঞ্জ কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ২০১৭ সালে কলেজটি জাতীয়করণ হলে তিনি ইস্তফা দেন। এরপর নেতাকর্মীদের কাছে ক্লিন ইমেজের কামাল পুরোপুরি বিএনপির রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন।
অধ্যাপক কামাল বলেন, দলের চরম দুঃসময়ে আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে নেতাকর্মীদের সাহস জুগিয়েছি। আওয়ামী লীগের অত্যাচার আর নির্যাতনে তারা যেন পথ না হারান সেজন্য বুক দিয়ে আগলে রেখেছি। বহু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারেক রহমানের নির্দেশে দলের কর্মসূচি পালন করেছি। এ কারণে মামলা ও হামলার শিকার হয়েছি। বাগমারা উপজেলা বিএনপি সাত ভাগে বিভক্ত ছিল। এখন নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। আশা করছি, দল আমাকে মূল্যায়ন করবে।
রেজাউল করিম টুটুলের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ২০০০ সালে ছাত্রদলের মাধ্যমে। ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তিনি টানা ৫ বছর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ২০২১ থেকে রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য সচিব। এছাড়া ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তিনি জেলা বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সহসম্পাদক ছিলেন।
রেজাউল করিম টুটুল বলেন, আমি দীর্ঘদিন থেকে বাগমারায় রাজনীতি করছি। বাগমারায় বিএনপির সফল নেতা সাবেক এমপি আবু হেনা প্রয়াত হয়েছেন। আরেক ত্যাগী এবং প্রবীণ নেতা আব্দুল গফুর বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বর্তমানে তিনি আমেরিকা প্রবাসী। এ কারণে বাগমারায় বিএনপির রাজনীতিতে কিছুটা নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। তাদের অনুপস্থিতিতে আমি এ অভাব পূরণ করতে চাই। বাগমারার তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে কাজ করছি। আর নেতাকর্মীদের প্রত্যাশার জায়গা থেকেই দলের হাইকমান্ডের কাছে মনোনয়ন চাইব।
অপরদিকে এ আসনটিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য জামায়াতও সর্বাত্মক প্রস্ততি গ্রহণ করেছে। নেতাকর্মীরা দলীয় এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করেছেন। দলীয় প্রার্থী ঘোষণা না হলেও আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন জামায়াত নেতা ডা. আব্দুল বারি সরদার। চিকিৎসা সেবা প্রদানসহ নানা ভাবে সাহাজ্য সহযোগিতা দিয়ে এলাকায় তার জনপ্রিয়তা শীর্ষে।
বাগমারা উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা এ আসনে প্রার্থী নির্ধারণের জন্য স্থানীয়ভাবে নির্বাচন করেছি। ভোটের তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর প্রার্থীর নাম ঘোষণা দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের কোন তৎপরতা না থাকলেও থেমে নেয় জাতীয় পার্টির সংগঠনিক কর্মকান্ড। নির্বাচন সামনে রেখে দল সংগঠিত করতে কাজ করছেন নেতাকর্মীরা।
উপজেলা জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, এ আসন থেকে দুই বার জাতীয় পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিল। এখনো এখানে জাতীয় পার্টির ভাল অবস্থান রয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে কাজ করছি। আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়নও চাইবো।
যাযাদি/ এমএস