দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু মৎস্য হ্যারিটেজ হালদা নদীতে এবার বৈরী আবহাওয়া তথা তিন নং সতর্কতা সংকেতের মধ্যেই ডিম ছেড়েছে কার্পজাতীয় (রুই, কাতল, মুগেল ও কালিবাউশ) মা মাছ।
বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার থেকে পূর্ণ জোয়ারে ডিম সংগ্রহকারীরা জাল ভর্তি ডিম পেতে থাকে। চলতি মৌসুমের চতুর্থ জোঁতে ডিম ছাড়ায় ডিম সংগ্রহকারীদের মলিন মুখ হাসিমুখে পরিণত হয়েছে। কয়েকদিনের পরিশ্রমে সফলতা আসায় সৃষ্টিকর্তার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তারা। তবে এবারের মৌসুমেও গত মৌসুমের মত নিম্নচাপ চলমান থাকায় তারা শঙ্কিত ছিল। ডিম সংগ্রহকালেও গভীর নিম্নচাপের কারণে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত ছিল। ডিম সংগ্রহকারীদের মতে মূলত নিম্নচাপের আগে পরে মা মাছ ডিম ছাড়ে। তাই তাদের ধারনা ছিল শুক্রবার পুরোদমে ডিম ছাড়বে মা মাছ। কিন্তু বৃহস্পতিবার নিম্নচাপের মধ্যেই ডিম ছেড়ে দিয়েছে।
২০২৩ সালের মত এবারও রেকর্ডপরিমান ডিম পেয়েছে ডিম সংগ্রহকারীরা। সংরক্ষণ করার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় অনেকে দুই ঘন্টা পর নদী থেকে ডিম নিয়ে উঠে পড়ে। কুয়ায় ডিম রেখে শুক্রবার সকাল থেকেই পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে নদীর জোয়ারের সময় দ্বিতীয় ধাপে নমুনা ডিম ছাড়ে মা মাছ। নমুনা পেয়ে ডিম সংগ্রহকারীরা উঠে পড়লেও রাত দশটার পর পর আবারো নেমে পড়েন তারা। তবে নিরাশ হয়ে থেমে গেলেও পাহাড়ায় থাকেন তারা। কারন সন্ধ্যার পর থেকেই বজ্রসহ প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। সাথে পাহাড়ী ঢল। নমুনা পেয়ে তারা হাল ছাড়েন নি। যদিও নিম্নচাপে কিছুটা শঙ্কিত ছিল। গত বছর নিম্নচাপ থাকায় রাতে নিম্নচাপ কেটে যাওয়ায় ডিম ছেড়ে দিয়েছিল মা মাছ। উপস্থিত কেউ না থাকায় ডিম সংগ্রহ করতে না পারলেও পরদিন নদীতে ডিম দেখে ডিম সংগ্রহকারীরা নিশ্চিত হয়েছিলেন ডিম ছাড়ার বিষয়টি। এবার সতর্ক থাকায় কাঙ্কিত ডিম লুপে নেন তারা। রাত দেড়টার দিকে জোয়ারের শুরুতেই ডিম সংগ্রহের সরঞ্জাম নিয়ে নদীতে অবস্থান করে শত শত ডিম সংগ্রহকারী।
নদীর মাছুয়াঘোনা বাঁক হয়ে ডিম সংগ্রহকারীদের জালে ডিম আসা শুরু করে। পরে ধারাবাহিকভাবে পোড় আওলিয়া, কাগতিয়া ব্রিক ফিল্ড, অঙ্কুরিঘোনা, পাতাইয্যার টেক, কাটাখালি মুখ, বোবাইয়ার চর এবং সব শেষে নয়াহাট কেরাংতলি বাঁক এলাকায় ডিম ধরা পড়ে। অপরদিকে ভাটার সময় আমতুয়া, ফাঁড়ির মুখ, উরকিরচর, আজিমের ঘাট, মদুনাঘাট ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে ডিম আসে ডিম সংগ্রহকারীদের ফেলা জালে। নৌকার পাশপাশি এবারও বাঁশের ভোরকা লক্ষ্য করা গেছে ডিম সংগ্রহে।
মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত সবচেয়ে বেশি ডিম সংগ্রহকারী হোসেন জানান, তিনি গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকায় ডিম সংগ্রহে ছিলেন। তিনি চারশ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছেন। মাছুয়াঘোনা হ্যাচারির একটি সার্কুলার ট্যাঙ্কে ২৫০ কেজি ও তিনটি সিস্টার্ন ট্যাঙ্কে ১৫০ কেজি ডিম সংরক্ষণ করেছেন। এবার রেকর্ডপরিমান ডিম সংগ্রহ করে তিনি খুশি।
একই হ্যাচারিতে ১৫০ কেজি ডিম সংরক্ষণ করে ডিম সংগ্রহকারী মো. শফি বলেন, গতবার মৌসুম থেকে শিক্ষা নেয়ায় এবার সফল হয়েছি। নিম্নচাপের মধ্যে ডিম ছেড়ে দিলেও এবার আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি। সতর্কতা আমাদের হতাশ করেনি। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তবে মাছুয়াঘোনা, নয়াহাট, অঙ্কুরিঘোনা, আজিমের ঘাট এলাকায় রেকর্ডপরিমান ডিম সংগ্রহ হলেও নদীর নীচের দিকে পরিমান ছিল তুলনামূলক কম। ওইসব এলাকার অনেকে ডিম সংগ্রহে বিলম্ব করে নদীতে নামা ও জোয়ার ভাটায় কাঙ্কিত ডিম না পেয়ে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত নদীতে জাল ফেলে রাখতে দেখা গেছে।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম প্রতিবেদককে জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকেই হালদায় অবস্থান করছি। ডিম সংগ্রহ শেষে ডিম সংগ্রহকারীরা অধিকাংশই হ্যাচারিতে পরিচর্যায় ব্যস্ত। প্রতিকুল আবহাওয়া হলেও ডিম ছাড়ার পরিবেশ ছিল শতভাগ। রেকর্ডপরিমান ডিম সংগ্রহ করতে পেরে ডিম সংগ্রহকারীরা অত্যন্ত খুশি। বৃষ্টির মধ্যেও হালদা পাড়ে উৎসব বিরাজ করছে। হ্যাচারির যাবতীয় কিছু আগে থেকেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল যাতে পরিচর্যায় কারো অসুবিধা না হয়। ইতিমধ্যে মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে ২ হাজার ৫০ কেজি, শাহ মাদারিতে ১ হাজার ৫০ কেজি, মদুনাঘাটে ৫ শ ৩০ কেজি এবং ৫০ টি মাটির কুয়ায় ২ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংরক্ষণ করা হয়েছে। সে হিসেবে হাটহাজারীতে এবার ৬ হাজার ১৩০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে। তিনি আরো জানান, হাটহাজারীতে তিনটি হ্যাচারিতে তিনজন মৎস্য অফিসারের পাশাপাশি ছয়জন স্টাফ কাজ করছেন।
এদিকে ডিম সংগ্রহকারীদের মতে চল্লিশ কেজি ডিমে ১ কেজি হিসেবে প্রায় ১শ ৫০ থেকে ১শ ৬০ কেজির মত রেণু উৎপাদন হবে।
হালদা গবেষক ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, পরিবেশ শতভাগ অনূকুলে থাকায় চতুর্থ জোঁর শেষের দিকে মা মাছ ডিম ছেড়েছে। ডিম পরিপক্ক। সোমবার প্রথম দফায় দেয়া নমুনা ডিম পুরোপুরি পরিপক্ক না থাকলেও দ্বিতীয় দফার নমুনা ছিল পরিপক্ক এবং ছাড়ার উপযোগী। অবশেষে তাই হল নমুনা ডিম ছাড়ার কয়েক ঘন্টা পরই পুরোদমে ডিম ছেড়েছে মা মাছ। সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে রেণু উৎপাদনেও রেকর্ড করতে পারবে ডিম সংগ্রহকারীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকেই হালদায় অবস্থান করছি। এবার চতুর্থ জো'র শেষ সময়ে মা মাছ ডিম ছাড়ায় সবার মুখে হাসি ফুটেছে। সবার অক্লান্ত পরিশ্রম সফল হয়েছে। এসময় তিনি প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর, মিডিয়া কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান।