মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মৃত প্রতিমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল শিক্ষক নিয়োগ এবং এমপিওভুক্তি!

মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি
  ০১ জুন ২০২৫, ১৯:০৬
মৃত প্রতিমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল শিক্ষক নিয়োগ এবং এমপিওভুক্তি!
ছবি: যায়যায়দিন

যশোরের মণিরামপুরে এক বিদ্যালয়ে মৃত সাবেক প্রতিমন্ত্রী, মৃত এক প্রধান শিক্ষক সহ নিয়োগ সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ব্যক্তির স্বাক্ষর জাল-জালিয়াতি করে মোঃ বদরুজ্জামান নামে একজনকে সহকারী শিক্ষক (সমাজ বিজ্ঞান) হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

বিষয়টি নিয়ে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার পাইনের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী ফুঁসে উঠে তাকে কয়েকবার অফিস কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখে। এদিকে নিয়োগের ২০ বছর পর চলতি এমপিওতে বদরুজ্জামানের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে বেতন-ভাতা আসার খবর প্রচার হওয়ায় নতুন করে স্কুল এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

1

জানা যায়, ২০০৪ সালে বিজয়রামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মরহুম মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস। এ সময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন মোঃ ইনছার আলী। তারা দায়িত্বে থাকা কালিন বদরুজ্জামান নামে কোন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ প্রাপ্ত হননি। অথচ ২০ বছর পরে এসে নতুন প্রধান শিক্ষক তাপস পাইন জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বদরুজ্জামানকে সহকারি শিক্ষক (সমাজ বিজ্ঞান) হিসেবে নিয়োগ দেখিয়ে চলতি এমপিওতে তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে বেতন-ভাতা আসার বিষয়টি প্রচার হওয়ায় নতুন করে স্কুল এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় চলছে।

নিয়োগ সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র পর্যালোচনায় করে দেখা যায় মণিরামপুর উপজেলার গোপিকান্তপুর গ্রামের মৃত. কেরামত আলীর ছেলে মোঃ বদরুজ্জামান বাবুকে ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিজয়রামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীর ‘খ’ শাখায় সহকারী শিক্ষক (সমাজ বিজ্ঞান) পদে নিয়োগ দেয়া হয়। যোগদান দেখানো হয় ৫ জানুয়ারী ২০০৫ সাল। কিন্তু মজার বিষয় ম্যানেজিং কমিটি ৪ দিন আগেই অর্থাৎ ০১/০১/২০০৫ তারিখে এ যোগদানের অনুমোদন দিয়েছেন। অবশ্যই এসব ব্যাপারে কিছুই জানেননা তৎকালি প্রধান শিক্ষক ইনছার আলী।

অপর দিকে কথিত এ সহকারী শিক্ষক বদরুজ্জামানকে বিদ্যালয়ে উঠানোর জন্য (কর্মে রত করার জন্য) প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার পাইন বর্তমান ম্যানেজিং কমিটিকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। যা নিয়ে বিদ্যালয় এলাকায় জনসাধারণ ও ম্যানেজিং এবং শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক মিশ্র প্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়। এমনকি ক্ষুদ্ধ জনতা দূর্নীতিবাজ বতর্মান প্রধান শিক্ষক তাপস পাইন এবং কথিত সহকারী শিক্ষক বদরুজ্জামানকে বিদ্যালয়ে প্রবেশে বাঁধার সৃষ্টি করে। এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে ছুটি শেষে আগামী ২২ জুন বিদ্যালয় খোলা হলে দূর্নীতিবাজ শিক্ষকের বিরুদ্ধে আরও কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবে।

বদরুজ্জামানকে নিয়োগ দেখাতে রেজুলেশন খাতাসহ নিয়োগ সংশ্লিষ্ট সকল কাগজ পত্রে ম্যানেজিং কমিটির একাধিক মিটিংয়ে যাদের স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে তারা হলেন, নিয়োগ বোর্ডের সদস্য তৎকালীন সভাপতি সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, সাবেক প্রধান শিক্ষক মোঃ ইনছার আলী, প্রধান শিক্ষক প্রতিনিধি পদে সুবলকাটি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের মৃত প্রধান শিক্ষক আব্দুল আজিজ, তৎকালীন মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল হান্নান, ডিজি প্রতিনিধি মণিরামপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যার নাম নেই।

আর বিজ্ঞাপন প্রকাশ, প্রার্থী যাচাই-বাছাই এবং নিয়োগ অনুমোদন রেজুলেশন খাতায় সভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, সহসভাপতি মোজাহার আলী মহলদার, অভিভাবক সদস্য রবিউল ইসলাম, শাহাদাৎ হোসেন, আব্দুর রহমান, আব্দুস সাত্তার, দাতা সদস্য সিরাজ আলী পাটোয়ারী, শিক্ষানুরাগী মোজাহার হোসেন, শিক্ষক প্রতিনিধি আবুল কাশেম ও আব্দুল গণির স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে। যাদের সকলের স্বাক্ষর জাল জালিয়াতি বলে দাবি করেছেন তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ইনছার আলী।

এছাড়া ১০ জুলাই ২০২৪ সালে বদিরুজ্জামানে ৮ম শ্রেণির খ-শাখা থেকে মুল প্যাটার্নে পদায়ন দেখানো রেজুলেশন খাতায় সভাপতি দেখানো হয়েছে ঝন্টু পাটোয়ারীকে। কিন্তু তিনিও এমন কোন রেজুলেশন খাতায় স্বাক্ষর করেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান।

সাবেক প্রধান শিক্ষক ইনছার আলী গত ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারী অবসরে যাওয়ার পর আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যর হাত ধরে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তাপস কুমার পাইন ২০২৩ সালের ১জুন বিজয়রামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর তাপস কুমার পাইন কতিপয় ব্যক্তির যোগসাজসে ১৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কথিত ব্যক্তি মোঃ বদরুজ্জামানকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে বিদালয়ে উঠানোর চেষ্টা করছেন।

নিয়োগ সংশ্লিষ্ট রেজুলেশন খাতার স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখতে গেলে তৎকালীন সভাপতি সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মরহুম মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস এর পুত্র রশিদ বিন ওয়াক্কাস স্বাক্ষর ভুয়া দাবি করে বলেন, এসব বিষয়ে আমি শুনেছি। আগামী ২২ জুন স্কুল খোলা হলে সাবেক প্রধান শিক্ষক এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে বর্তমান প্রধান শিক্ষকের নিকট বিষয়টি জানাশোনা হবে।

সাবেক প্রধান শিক্ষক ইনছার আলী জানান, ৩৭ বছর শিক্ষকতার কর্ম জীবনে বদরুজ্জামান বাবু নামে কাউকে বিজয়রামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এমনকি আমার করা স্বাক্ষর নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সেটা আদেও সত্য নয়। তবে, যতটুকু শুনেছি বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার পাইন ও কতিপয় ব্যক্তিরা মিলে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কথিত ব্যক্তি বদিরুজ্জামানকে শিক্ষককে নিয়োগ দিয়ে এমপিওভুক্তি করানো হয়েছে।

সভাপতি ঝন্টু পাটোয়ারী জানান, ২০২৪ সালে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বে থাকাকালীন মোঃ বদরুজ্জামান নামে কোন শিক্ষক স্কুলে ছিলনা। তাকে শাখা শিক্ষক থেকে মুল প্যাটার্নে পদায়ন রেজুলেশন খাতায় আমার স্বাক্ষর কিভাবে এলো এটা আমার জানার বাইরে।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার পাইন এর ব্যবহৃত ০১৭১৩৭০৫৬০৬ নম্বর মুঠো ফোনে বারংবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি রিং রিসিভ না করে কেটে দেন।

মণিরামপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম বজলুর রশিদ জানান, নিয়োগটি অনেক আগের যে কারনে যাচাই বাছাই করার সুযোগ হয়নি। পেপার পত্রিকায় আসলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার মাহফুজুল হোসেন জানান, উপজেলা থেকে ফাইল যেভাবে আসছে আমি সেইভাবে ডিডিতে ফরোয়াডিং করেছি। তবে বিষয়টি জানার পর নোট করেছি খুব গুরুত্বের সহিত খতিয়ে দেখা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে