সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝরছে। ঘনকালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে বিজলি চমকাচ্ছে। সেই
সাথে বিজরীর মনেও শঙ্কা কাজ করছে। তবে কি আজও কোরবানির হাটে যাওয়া হবে না। গত দু’দিনের টানা বৃষ্টির কারণে গরুর হাট ঠিকমতো বসতে পারেনি। সে কারণে বিজরীরও বাবার সাথে কোরবানির হাটে যাওয়া হয়নি।
আজও সেই অবিরাম বৃষ্টি। বিজরীর মনাকাশে কালো মেঘ ছেয়ে গেছে। একটু পরপর দরজাটা ফঁাক করে বাইরের দিকে তাকায় সে।
দূর থেকে মেয়ের এমন কাজ দেখে সোলায়মান সাহেব মিটিমিটি হাসেন। তারপর বিজরীকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
- এভাবে বারবার বাইরে গিয়ে কি দেখছো, মামনি!?
বিজরী আমতা আমতা করে বলল,
- না বাবা, বৃষ্টি থামলো কিনা তা দেখছি।
- তো বৃষ্টি কি থেমেছে?
- না বাবা, এখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। বাবা, বৃষ্টি এমন কেন? সময়-অসময় বোঝে না। আর মাত্র কদিন পর ঈদ। এখন কি বৃষ্টি না হলেই নয়?
সোলায়মান সাহেব বিজরীর কথা শুনে একগাল হাসলেন। মেয়েকে কোলে করে সোলায়মান সাহেব ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন। ব্যালকুনীতে দঁাড়িয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। বিজরী তখন আনন্দে লাফাতে লাগল। বৃষ্টি একেবারে থেমে গেছে। আকাশেও কালো মেঘ নেই।
বিজরী বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
- বাবা, এখন তো বৃষ্টি নেই। চল, কোরবানির হাটের দিকে যাই।
বিকাল সাড়ে চারটা। বিজরীকে সাথে নিয়ে সোলায়মান সাহেব কোরবানির হাটের দিকে এলেন। এবার ‘লেবার কলোনি’ মাঠে কোরবানির হাট বসেছে। বিশাল মাঠ। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। সারি সারি গরু বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে বেঁধে রাখা হয়েছে। লাল গরু, সাদা গরু, কালো গরু, দেশি-বিদেশি গরু, বড় গরু, ছোট গরু ইত্যাদি।
সোলায়মান সাহেব জন্মসূত্রে চট্টগ্রামের বাসিন্দা। চরম অসময়েও নিজেদের বংশগত ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হাটের সবচেয়ে বড় গরু কোরবানি দিতে বাপ-দাদাকে দেখে এসেছেন। নিজেও তার ব্যতিক্রম নন।
পুরো হাটে বিজরীকে নিয়ে গরু দেখলেন। সোলায়মান সাহেবের বেশ কয়েকটি গরু পছন্দ হলেও বিজরীর আপত্তির কারণে সেগুলোর দরদাম করা হয়নি। হঠাৎ বিজরী চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘ঐ দেখো বাবা, বিশাল,সুন্দর লাল গরু। তোমাকে এই গরুটাই কিনতে হবে।’
সোলায়মান সাহেব বিজরীকে সাথে নিয়ে গরুটির কাছে আসলেন। ভালোভাবে গরুটিকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। গরুটির পিঠে সুউচ্চ কুঁজ রয়েছে। বিশালাকার গরুটির পুরো গা লাল রঙের পশমে ঢাকা। রং বেরঙের জরি প্যঁাচানো শিং দেখে মনে হচ্ছে যেন রাজার মাথায় রঙিন মুকুট জ্বলজ্বল করছে। তার ওপর গলায় সুন্দর মালা পরানোয় বেশ আকষর্ণীয় দেখাচ্ছে। গরুটিকে ঘিরে মানুষের ভিড় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
সোলায়মান সাহেব বিজরীর কানে কানে বললেন,
- কি মামনি, গরুটি কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
বিজরী খুশিমনে বলল,
- বাবা, গরুটি খুব সুন্দর। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এই গরুটিই নিয়ে নাও।
সোলায়মান সাহেব মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
- আরও আস্তে বল, মামনি। গরুর মালিক শুনলে দাম বাড়িয়ে দেবে।
বিজরী চুপচাপ দঁাড়িয়ে লাল গরুটার দিকে তাকিয়ে রইল।
সোলায়মান সাহেব গরুর মালিকের আরো কাছে এগিয়ে এসে কানে কানে জিজ্ঞেস করলেন,
- ভাইজান, গরুটার দাম কত?
- ‘দুই লক্ষ পঁচিশ হাজার’ টাকা।
গরুর দাম শুনে সোলায়মান সাহেবের কপালে চিন্তার ভঁাজ পড়ল। মনে মনে ভাবতে লাগলেন- গরুটির দাম দেড় লাখের বেশি হওয়া অন্যায়। গরুটি যে বিজরীর খুব পছন্দ হয়েছে তা নিশ্চিত গরুর মালিক বুঝতে পেরেছে। তাছাড়া আমার বাজেট মাত্র ‘এক লাখ’ টাকা।
ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে বিজরীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে গরুর মালিককে বললেন,
- ভাই, ‘দেড় লক্ষ’ টাকা হবে।
- না, ভাই, আমি গরুর দাম বেশি চাইনি। যদি নেন একদাম ‘দুই লক্ষ’ টাকা দিতে হবে।
সোলায়মান সাহেব মন খারাপ করে বিজরীর কাছে ফিরে আসেন।
বিজরী উৎফুল্ল হয়ে বলল,
- বাবা, গরুটি কি নিয়েছ?
- না, মা, চল আমরা অন্য কোনো গরু নেব। গরুর মালিক অনেক বেশি দাম চাইছে।
এই কথা বলে সোলায়মান সাহেব বিজরী সাথে নিয়ে হঁাটতে লাগলেন। বিজরী গরুটার দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কঁাদতে লাগল। কোন অজানা কারণে গরুটিও বিজরীর দিকে তাকিয়ে হাম্বা হাম্বা স্বরে চিৎকার করতে লাগল। উপস্থিত লোকজন বিজরীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সোলায়মান সাহেব বিজরীকে আপ্রাণ বুঝালেন। কিন্তু বিজরীর সেই একই কথা। লাল গরুটা কিনতে হবে।
গরুর মালিকও বিষয়টি লক্ষ্য করলেন। তারপর গরুটির দড়ি হালকা ছেড়ে দিয়ে সোলায়মান সাহেবের কাছে এসে বললেন,
- ভাই, ও কি আপনার মেয়ে?
- হ্যঁা।
- এভাবে কান্না করছে কেন?
- আপনার গরুটা ওর খুব পছন্দ হয়েছে। আমারও। কিন্তু আমার বাজেট ছিল ‘এক লাখ টাকা’। আমি ‘দেড় লাখ টাকা’ বলেছি শুধু আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।
গরুর মালিক একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
- শুধু আপনার মেয়ের জন্য গরুটি আমি আপনার কাছে বিক্রি করছি। তবে আমাকে ‘এক লাখ আশি হাজার টাকা’ দিতে হবে। তাতে আমার খুব একটা লাভ হবে না।
সোলায়মান সাহেব আর কোন কথা না বাড়িয়ে ‘এক লাখ আশি হাজার’ টাকা মূল্যে গরুটি কিনে নিলেন।
বাসায় এনে প্রথমে বাসার সম্মুখের প্রধান ফটকের সাথে বেঁধে রাখা হলো। গরুর মালিক তার পাওনা বুঝে পেয়ে নিজ গন্তব্যে চলে গেলেন।
শুরু হলো গরুর পরিচযার্। কিছুক্ষণ পরপর ভালো ভালো খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। খাবার দেবার সময় বিজরী ভয়ে ভয়ে গরুর মুখে খাবার তুলে দেয়। গরুটিও মাথা নাড়তে নাড়তে তা মুখে নিয়ে নেয়। এরপর কিছু মুহূতর্ তা চিবিয়ে স্থির দঁাড়ালে বিজরী আবার দেয়।
এই দুই দিনে বিজরী ও লাল গরুটির মাঝে খুব ভাব হয়। এক মুহূতর্ সময় পেলে বিজরী গরুটির কাছে ছুটে যায়। আশপাশের লোকজন নিয়মিতভাবে লাল গরুটিকে দেখতে আসছে।
আগামীকাল ঈদ। লাল গরুটির পুরো মুখমÐলে বিষণœতা। চোখ থেকে পানি ঝরছে। বিজরী মনে মনে ভাবছে, তবে কি লাল গরুটি বুঝে গেছে কাল ঈদের দিন তাকে কোরবানি দেয়া হবে! তা কি করে সম্ভব! ওরা কী মানুষের কথা বোঝে?
আজ কোরবানির ঈদ। চারদিকে পশু কোরবানি হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিজরীদের গরুটির পা ভালো করে দড়ি দিয়ে বেঁধে গলাটা পশ্চিম দিক করে শোয়ানো হয়েছে এবং কিছু লোক পা ও মাথা শক্ত করে চেপে ধরে আছে। গরুটি ভেজা চোখে যেন শেষবারের মতো বিজরীকে দেখার জন্য ঘাড়টা নাড়াতে চাইল। অদূরে বিজরী বিষণœ মনে দঁাড়িয়ে আছে। ওর চোখ দুটো যেন ছলছল করছে।
সদস্য
জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম,
বেপজা পাবলিক স্কুল ও কলেজ, চট্টগ্রাম