শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভ‚মিপুত্র শামসুর রাহমান

সুজন হাজারী
  ২৬ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

প্রিয় দুই অক্ষরের শব্দ দ্যোতনায় ব্যবহার বহুবিধ বহুমাত্রার। এ শব্দের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার নিবিড় সম্পকর্ বিজড়িত। যা কিনা কান টানলে মাথা আসার শামিল। ভালোবাসার আবার ভাবাবেগের বিষয়। যা হৃদয়মথিত অনুভ‚তি সঞ্চালিত এক ধরনের তাড়না। এ তাড়না মানুষকে প্রণোদনা জোগায় প্রভাবিত করে। ভালোবাসা বিষয়টি পরস্পরবিরোধী হতে পারে। যেমন ‘কঁাদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে: (স্বরবিতান-২), ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে’ (গীতবিতান-২, স্বরবিতান-৪০)। রবীন্দ্রনাথের এ দুটো গান থেকে পরস্পর বিরোধিতার প্রমাণ মেলে। গানের কথা ও ভাবসম্পদ নিয়ে ভাবলে বিরোধিতা পরিষ্কার হয়ে যায়।

ভালোবাসা হাতে, পায়ে, গায়ে মাখা বস্তুসামগ্রী নয়। অন্তর উৎসারিত উপলব্ধি বোধের অনুভ‚তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মানুষের চলনে-বলনে আচার-আচরণ জীবনপ্রক্রিয়ার আংশিক প্রকাশও বটে। আগেই বলেছি প্রিয় শব্দটি বহুবিধ ব্যবহৃত। একজন মানুষের কাছে আকাশের চঁাদ থেকে বাড়ির পোষা বেড়াল, ফুল, পাখি গান, কবিতা, নারী, সমুদ্র, পাহাড় কিংবা ব্যক্তি কবির কাছে অনেক কিছু প্রিয় হতে পারে। প্রিয়কে সংখ্যা বা সীমায় আবদ্ধ করা যায় না। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি বলি আমি নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিদেল ক্যাস্ত্রো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, অং সান সু চি, হ্যাভেল শাভেজ, মহাত্মা গান্ধী, ইন্দ্রিরা গান্ধী, তাজুদ্দীন আহমদ কিংবা বারাক ওবামা আমার প্রিয়। অনুরূপভাবে আমার কাছে প্রিয় কবি হিসেবে একক কোনো কবিকে প্রিয় বলার সাহস নেই। শুধু তাই নয়Ñ এক ভাষার কোনো এক কবিকে প্রিয় শনাক্ত করা ব্যাখ্যাতীত। একজন কবির কাছে অনেকে কবির কবিতা প্রিয় হতে পারে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনারতরী’, কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ জীবনানন্দ দাসের ‘রূপসী বাংলা’ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’ সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ‘রানার’ শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ নিমের্লন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ বিনয় মজুমদারের ‘উজ্জ্বল মাছ’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ এসব কবিদের অমর সৃষ্টি উল্লিখিত চিরকালিন শাশ্বত কবিতার কোনো কবিকে অপ্রিয় বলার মুরোদে কুলায় না। ভাষার পাথর্ক্য থাকলেও ভাষান্তরের সুবাদে বিশ্বসাহিত্য এখন বলা চলে হাতের মুঠোয় এসেছে। এ ক্ষেত্রে প্রাচ্য প্রতিচ্যের কোনো বিভাজনের অবকাশ নেই। যদি ইচ্ছা থাকে পরস্পরকে জানা ও পাঠের সুযোগ বিজ্ঞানের অবদানে নিহিত। এ যুগে শুধু আকাশ সংস্কৃতির বোতাম টিপলেই মুহূতের্ই তা জানা সম্ভব। আরবি ভাষার কবি এডোনিস, মাহমুদ দারবীশ, উদুর্র ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ইংরেজির এজরা পাউন্ড, এলেন গিন্সবাগর্, গাব্রিয়েল গাসির্য়া মাকের্জ, গুনটার গ্রাস, বোহের্ লুই বোহের্স, অন্য ভাষার পাবলো নেরুদা, অ্যান্তনি চে’গুয়েভারা, আফ্রিকার চিনুয়া আচেবে, সোয়েলেঙ্কার, বাংলার রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, শক্তি, বিনয়, উৎপল, রনজিত, আবুল হোসেন, মারাঠি কবি রাজা ঠাকুর অনেকে আমার প্রিয় কবি। কাকে রেখে কার কথা বলি। এজন্য একক কোনো কবির ক্ষেত্রে প্রিয় বলার তকমা স্থিত নয়। এ তকমা কতটা সমীচীন এ নিয়ে আমি প্রশ্নবিদ্ধ। প্রিয় বলার সঙ্গে হেরফের রয়েছে। প্রিয়র সঙ্গে যেহেতু আবেগমিশ্রিত তাই সেটা অনিবাযর্ ও অনিরুদ্ধ। আমার কাছে নিবন্ধের দাবিদার আমার একজন স্নেহান্যুজ বাংলা ভাষার কবিতা শ্রমিক। বাংলা ভাষা এক ইতিহাসসমৃদ্ধ ভাষা। বহু প্রাণের বিনিময়ে আমাদের মায়ের মুখের ভাষা বিশ্বস্বীকৃতি লাভ করেছে। এ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রেম, ভালোবাসায় আমি সিক্ত। আমার স্নেহান্যুজর দাবিতে আমি আমার কাছেই ফিরে আসি। অন্যসব প্রিয়কে বিসজর্ন দিয়ে আমি আমার দেশের আমার একজন প্রিয় কবিকে নিবার্চন করেছি। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরীক্ষার খাতায় প্রিয় কবির সম্পকের্ রচনা লিখেছি। এখন দাবি মেটাতে প্রিয় কবির রচনা লিখে দিলে কাজটা সহজ হতো। এ কাজ করলে পাঠক থুতু ছেটাবে। তা ছাড়া আমি প্রাবন্ধিক নই। প্রবন্ধ নিবন্ধের ক্ষেত্রে বিস্তর তথ্য, তত্ত¡, উপাত্ত, তাত্তি¡ক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়। এ সবকিছু আমার মগজের এন্টেনায় ক্যাচ করে না। বিধায় আমি নিজর্লা প্রবন্ধ রচনা থেকে বিরত থাকি। বন্ধু আমার নাছোড়বান্দা অগত্যা এই প্রয়াস। কবি একজন শিল্পী। তার সৃষ্টিকমর্ হলো শিল্প। প্রিয় কবির সম্পকের্ লিখতে শিল্পী আর শিল্প নিয়ে অবতারণার প্রয়াস একান্তই বাঞ্ছনীয়। এখানে আমার পাÐিত্য ফলানোর অবকাশ নেই। কারণ আমার মধ্যে পাÐিত্যের ‘প’ অক্ষরটিও খঁুজে পাওয়া দুষ্কর।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যাবতীয় শিল্পই ‘ঊীঢ়বৎরসবহঃ ড়ভ ঢ়বৎংড়হধষরঃু’ বা ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি। এই পাসোর্নালিটি প্রাত্যহিক ক্ষুৎপিপাসার ঊধ্বর্স্থ অখÐ স্রষ্টা সত্তা। রবীনদ্রনাথ অন্য প্রসঙ্গে যাকে বলেছেন ‘বড় আমি’ আর ‘ছোট আমি’ হচ্ছে ‘ইনডিভিউজুয়াল’ নয়। সাধারণ মানুষ হিসেবে শিল্পী ক্ষুদ্রতার দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু শিল্পী কখনই জাগতিক তুচ্ছতার দ্বারা আন্দোলিত হন না। সেই কারণে শিল্পীর যথাথর্ পরিচয় মিলবে না তার প্রাপ্তহিক জীবনে। কবিরে পাবে না তার জীবন চরিতে। কবির ব্যক্তিজীবন শেক্সপিয়র, ওয়াডর্স ওয়াথর্ টেনিসন অথবা বাল্মীকি কালীদাসের ব্যক্তি জীবনের ঘটনা থেকে লাভ করা সম্ভব হবে না এদের স্রষ্টাজীবনের ইতিবৃত্ত। তার সৃষ্টির উৎসস্থল সংকেত দেয় না। সত্য হলো যে, শিল্প তার সৃষ্টির সময় তার ব্যক্তিজীবনের ঊধ্বের্ থাকেন। আর তার সৃষ্টিকমর্ আবেগ থেকে রসের জগতে উত্তীণর্ হয়। সৃষ্টি সম্পকের্ শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলা যায় ‘যদি পরম সুন্দরের প্রত্যক্ষ উপমা পেয়ে সত্যই কোনদিন মিটে যায় মানুষের এই স্পৃহা তবে ফুলের ফুটে ওঠার, নদীর ভরে ওঠার, পাতা ঘন সবুজ হয়ে ওঠার, আগুনের জ্বলে ওঠার সঙ্গে মানুষের ছবি অঁাকা মূতির্ গড়া, কবিতা লেখা, গান গাওয়া ইত্যাদির স্পৃহা থাকে না (সৌন্দযের্র সন্ধানে বাগেশ্বরী প্রবন্ধাবলি- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। কবিরা সুন্দরের পূজারি। কবিরা শিল্পী। শিল্পী বলেই যে কেবল পরম সুন্দরকে খুঁজে ফিরছে তা নয়। পরম সুন্দরও শিল্পীকে খেঁাজেন। একজন শিল্পী মনের মানসলোক ঠিক হেগেলের অনংড়ষঁঃব বা এ যে রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা, শামসুর রাহমানের বাগদেবী। যার উদ্দেশ্য কবির রচনা

‘আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে তোমার চন্দ্র সূযর্ তোমায় রাখবে কোথায় ঢেকে’ শিল্পীর কাছে সুন্দর মনের গহীন তলা থেকে উঠে আসা সোনা। তার সেই ঐশ্বযর্ মনের তলা থেকে কুড়িয়ে আনা সাত রাজার ধন। নন্দনতাত্তি¡ক পÐিতেরা বলেন যে, ‘স্বহৃদয় সংবাদী রসিক মন ছাড়া অন্য কারো রসের অমৃতময়লোকে প্রবেশের অধিকার নেই। এই স্বহৃদয় হৃদয়সংবাদী রসিক জনকে রস পরিবেশনের জন্য শিল্পীকে ইউনিভাসাির্লটি হাতুড়ি দিয়ে সুন্দরকে ভেঙ্গে টুকরো করে ফেলার দরকার হয় না। শিল্পীর নিজস্ব রূপবোধ যা ধরা পড়ে শিল্পে, তাকে সত্যিকার বোঝে রসিক মন। কবি তার অনুভ‚তির কথা বলেন, অন্য সবাই তা বুঝল কি বুঝল না সে কথা তার ভাবার দরকার নেই।’

রবীন্দ্রসাহিত্যে উপনিষদিক সচ্চিনানন্দ স্বরূপের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে, ‘মহৎ আনন্দই সকল সৃষ্টির উৎস। শিল্পীর আনন্দ হলো বিশুদ্ধ বিমুক্ত আনন্দ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে সুখানুভ‚তি তা এ আনন্দের সমাথর্ক মনে করলে ভুল করা হবে। আত্মার যেখানে বন্ধন মুক্তি ঘটে সেখানে এ আনন্দের আস্বাদন করা যায়। শিল্প প্রকাশের মাধ্যমে আত্মার বন্ধন মুক্তি ঘটে।’

রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি ও জীবনী পড়লে জানতে পারি তার মানবতাবাদের উৎস পাওয়া যায় সন্ধ্যা সংগীত পবের্। যার উৎসারণ পরবতীর্ সময়ে প্রকৃতি, মানুষ, ঈশ্বর এই তিনে ভালোবাসার পাত্রে কবির সারাজীবনের অঘর্ সমপির্ত হলেও বিশ্বরূপের খেলাঘরে যে দেবতাটি তার প্রাণমন হরণ করেছেন তিনি ‘মানুষ’। মানুষের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূণর্ বিশ্বকে আমরা সত্য বলে জ্ঞান করি ও মানি সুন্দররূপে দেখি। মানবিক বিশ্বই মানুষের কাছে সত্য। প্রাচীন যুগের কবি বুড়ো চÐীদাস তার অমৃত বাণীতে বলেছেন,

‘সবার উপরে মানুষ সত্য

তাহার উপরে নাই’।

শুধু তাই নয়Ñ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,

‘গাহি সাম্যের গান মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই

নহে কিছু মহীয়ান’।

আমি যখন কবিতার জগতে হঁাটিহঁাটি পা পা করি তার আগে বালক বেলায় পাঠ্যসূচিতে কবিতা পড়ে নিজের অজান্তে কবিতাকে ভালোবেসেছি মনে-প্রাণে। ক্লাসের পাঠ্যবইয়ে যে কবিতা মুখস্থ করেছি রাতে শুয়ে কবিতার ছন্দ মনে দোলা দিত। শিশু মনে কবিতা যা বুঝতাম তা মনে মনেই থাকত। আলোর মুখ দেখত না। হাই স্কুলে পড়ার সময় প্রথম স্কুল ম্যাগাজিনে লেখার সুযোগ আসে। সেই আমার লেখার সূত্রপাত। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার কারণে এক কবি বন্ধুর সঙ্গে খাতির জমে উঠল। সে সময়ে সংবাদ পত্রিকার খেলাঘরে তার লেখা ছাপা হতো। এ কথা শুনে তাকেই কবিতা লেখার প্রদশর্ক মনে করলাম। সে আরবান শহরের বাসিন্দা আমি নিভৃত গ্রামের। নিজের জ্ঞান-গরিমায় রেটিংয়ে অন্তত আমার থেকে সে অগ্রগামী। এ কথা স্বীকার করে গবের্বাধ হয়েছে। একদিন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একজন কবির প্রকাশিত কবিতা দেখিয়ে দিয়ে বলল পড়ে দ্যাখ। সত্যি বলতে কি সে কবিতার আগাপাশতলা কিছুই বুঝিনি। সে বলত তুই যা লিখিস তা ছেড়ে দে। কবিতা এভাবেই লিখতে হবে। এ হলো আধুনিক কবিতা। পদ্য লেখার দিন শেষ। বন্ধুর হিতোপদেশ কাজে লেগেছিল। তার পরামশের্ আজ আমি বতর্মান অবস্থায় রয়েছি। আমি সাহিত্যচচার্র মধ্যেই বেঁচে আছি। বড়ই পরিতাপের বিষয় বন্ধুটি আমার নেই। প্রায় ২৫ বছর আগেই সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। তার লেখা গণসংগীতের একটি লাইন এই মুহ‚তের্ মনে পড়ল ‘পেটে হাত দিলে কারো ক্ষমা নেই’ কি মারাত্মক কথা। নিরন্ন দরিদ্র মানুষের রুজি রেজেগ যারা কেড়ে খায় তাদের বিরুদ্ধে এর চেয়ে উচ্চকণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ কি হতে পারে? ক্ষমাহীন ক্ষমার অযোগ্য এ প্রতিবাদ শুধু কবির নয়Ñ তামাম পৃথিবীর নিরন্ন ক্ষুধাতর্ দরিদ্র মানুষের অধিকার সোচ্চারিত হয়েছে এই বাণীতে। বন্ধুটি কবিতা, ছড়া, গণসংগীত লেখার পাশাপাশি ভাস্কযর্ তৈরি করত, কাটুর্ন ও ছবি অঁাকত। বহুমুখী শিল্পীর প্রতিভা কজন হতে পারে। এমন আফসোস এখনো বুকে পুষে রেখেছি। সে ছিল বোহেমিয়ান। তার কোনো লেখায় সে কোনো সংরক্ষণ করত না। যখন যা লিখত হাতের কাছে যে কাগজ পেত সে ছাপতে দিত। আমার জানামতে সে যখন বগুড়া আযিযুল হক কলেজে পড়ত সে সময় বগুড়া ছিল লিটল ম্যাগাজিনের ভ‚স্বগর্। সেখানের অনেক ম্যাগাজিনে তার গল্প, কবিতা, ছড়া জয়পুরহাটের উদীচীর থেকে প্রকাশিত গণসংগীতের প্রত্রিকায় একগুচ্ছ গণসংগীত প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর পর তার বাসায় খঁুজে একটি গল্প কয়েকটি কবিতা উদ্ধার করেছি। যা ছাপা হয়েছে বগুড়ার রেজাউল করিম চৌধুরীর ‘অক্রের্স্টা’ ও মঞ্জু রহমান সম্পাদিত ‘টোঙ’ পত্রিকায়। মৃত্যুর আগের দিন দেখা করেছিলাম তার বাসায়। কঠিন কোনো অসুখ ছিল না। শুধুই জ্বর। এক প্রকার উন্নত চিকিৎসার অভাবে মারা গেল। আমাকে বলেছিল ডাক্তার দেখাতে রাজশাহী যাবে। কিন্তু কেন যায়নি সে উত্তর আমার অজানা। তার অকাল মৃত্যুর দগদগে ঘা আমার ও অন্যান্য সব বন্ধুরা আজও পুষে রেখেছেন। আমি ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি না। আমার প্রিয় কবিকে চেনানোর পথ প্রদশর্ক কবি অমিয় সাহা। তারুণ্যে সে ছিল আমার প্রথম কবিবন্ধু। প্রিয় কবিকে নিয়ে লেখার সুবাদে বিষয়টি প্রাসঙ্গিকক্রমে এ লেখায় আমার সঙ্গে সম্পৃক্ততায় যৌক্তিকভাবে এসে পড়ল। যা পাঠকের বিবেচনায় ঠঁাই পাবে।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর বাংলা কবিতাবিশ্বকে শাসন করেছে তিরিশের কবিরা। তারা বাংলা সাহিত্যের কল্লোল যুগ হিসেবে চিহ্নিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি কবিতার চচাের্ক দশক বন্দি করার পক্ষ সমথর্ন করি না। তবু প্রচলিত ধারাক্রমানুসারে বলতে দ্বিধা নেই, তিরিশের পর চল্লিশের কবিতা পাশ্চাত্যের সমন্বয়হীনতায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। অগ্রসরমান তিরিশের আধুনিক কবিতার অভিযাত্রাকে যেভাবে এগিয়ে নেয়ার কথা ছিল ঠিক সেভাবে এগিয়ে নিতে তারা সমথর্ক হননি। কারণ তিরিশের যে সব মেধাবী কবির আবিভার্ব হয়েছিল চল্লিশে তা ছিল অনুপস্থিত। তিরিশের তুলনায় চল্লিশের শক্তিমান কবির অপ্রতুলতা পরিলক্ষিত হয়।

পক্ষান্তরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আবহে অভিজ্ঞতা প্রসূত পঞ্চাশের বহু শক্তিমান কবি পুরুষের আবিভার্ব ঘটেছে। এদের কেউ কেউ উদ্দীপ্ত মেধার দীপ্রতায় শাসন করেছেন বাংলা কবিতাকে ছয় দশকজুড়ে। কাব্য জগৎজুড়ে নন্দিত জনপ্রিয় বহুপ্রসূ আন্তরিক কবিতাভাব সম্পূণর্ মেধাবান শক্তিশালী কবিই নয় সেই সঙ্গে অনবদ্য গদ্য শিশুসাহিত্য সংগীত নিমাের্ণ দক্ষতা ও নিজস্বতার স্বাক্ষরবাহী এ কবি হলেন ঈশ্বরের বরপুত্র শামসুর রাহমান। প্রসঙ্গত তিনি তৎকালীন পূবর্ বাংলা বতর্মানে সোনার বাংলার বিরলপ্রজ ক্ষণজন্মা এ দেশের ভ‚মিপুত্র। বহু বৈচিত্র্যে বিশিষ্ট বিনিমাের্ণ সমৃদ্ধ এ কবির কাব্যিক পরিমÐল। পঞ্চাশ দশকের উভয় বাংলার কবিদের মধ্যে জীবনানন্দীয় প্রভাব আছন্ন দুমর্রভাবে পরিলক্ষিত হয়। যা প্রবাহমান ষাটের দশকে ছিল। শুধু ষাট পযর্ন্ত ক্ষান্ত হবে কেন। ষাট পরবতীের্তও অনেকের মধ্যে অল্প-বিস্তর হলেও জীবনানন্দের প্রভাব সবার্ত্মক নিবাির্সত হয়েছে বলে বিশ্বাস করা প্রকৃত অথের্ই শক্ত হবে। কবি শামসুর রাহমান সে প্রভাবমুক্ত নন। ‘ছাত্রাবস্তায় প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। কাব্যগ্রন্থে নিশ্চেতনার চেতনা আসলে জীবনানন্দীয় এষণা। এ আছন্নতা শামসুর রাহমানের মধ্যে স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি বেশিদিন। তিনি তা কাটিয়ে উঠে তার নিজ কবিসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন অচিরেই। এ কাব্যগন্থের নামকরণে শামসুর রাহমানের প্রাগ্রসর আধুনিক কবি মানসের পরিচয় মেলে। এ কাব্যের শামসুর রাহমান যেমন রোমান্টিক তেমনি ম্যাটাফরিস্ট (গবঃধঢ়যড়ৎরংঃ রূপক ব্যবহারে দক্ষ বা অভ্যস্ত ব্যক্তি)। শামসুর রাহমানের কাব্যগন্থের নামকরণ যে কাউকে ভাবিত করে। চিন্তার গভীরে প্রবেশ করায়। নামে চমক’ তো আছেই। তা ছাড়া এ নামের অথর্ বা মমোর্দ্ধার করা অত সহজ নয়। এখানে কবিত্ব শক্তিতে তিনি ধীমান। এ নামের ব্যাপকাথের্ বা ভিন্নাথের্ অভিনিবেশী অনুসন্ধিৎসায় পরজাগতিক বা আধ্যাতিকতার আবহ সংকেত আছে বলে প্রতীয়মান হয়। কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় অংশটি পাঠককে অথই চিন্তার গভীরে নিমজ্জিত করে। অন্তত আমার মতো গড়পড়তা মানের বোদ্ধাদের ক্ষেত্রে তো বটেই। আমার বোধ্যতায় কাব্যগন্থটি ব্যাখ্যা করলে প্রথমাংশের অথর্ দ্বারা সুদূরপ্রসারী দূরদশির্তা পরিলক্ষিত হয়। যা কিনা আবহমান প্রাকজীবন দশের্নর প্রতিচিত্রকল্প। এখানের ম্যাসেজ মানবজীবনের আগাম বাতার্ পৌঁছে দেয়। তার আগে কবি মানসের অবধারিত মানসিক মৃত্যু ঘটেছে। তাই জাগতিক দেহাতি মৃত্যু দ্বিতীয় মৃত্যু হিসেবে শনাক্ত। তার আগে এ অংশে রোমান্টিক দাশির্নক চিন্তার অবকাশের মাধ্যমে প্রথম গানে সেই ইঙ্গিত করেছেন কবি ম্যাটফরিস্ট ক্যারিশমায়। কবি এখানেই সাথর্ক। তার এ গ্রন্থের নামকরণের রহস্যময়তা আকৃষ্ট করে। আমার কাছে শামসুর রাহমান প্রিয় কবির স্থান দখল করেছেন মনে-প্রাণে। তিনি কবিতায় দেশ ও সময়কে ধারণ করেছেন ভিন্ন মাত্রায়। যে সময় তিনি কাব্যচচার্য় এসেছেন নিজের মানসপটে তাকে মৃত্যু ভাবনায় ভেবে দেহাতিক দ্বিতীয়বার মৃত্যুর আগে তার পুনজের্ন্মর আগাম সংকেত দিয়েছেন প্রথম গানে। প্রচারণা আমরা চিলির কবি পাবলো নেরুদার প্রসঙ্গে বলতে পারি তিনি কবিতায় চিলিকে চিলির বিপ্লবকে তার দেশের গান মানুষকে ধারণ করেছেন। শামসুর রাহমান এখানে তার কবিতায় তুলে এনেছেন নতুন একটি দেশের অভ্যুদয়ের প্রারম্ভিক সংগীত। আমার প্রয়াত কবিবন্ধু প্রথম শামসুর রাহমানের কবিতা হাতে ধরে দিয়েছিল। তখন সে কবিতা পড়ে না বুঝলেও তার নাম হৃদয়ে গেঁথেছিলাম। তার কবিতা চোখে পড়লেই সবাের্গ্র পড়েছি। কি মোহ। কি চুম্বাকাষের্ণ মোহাবিষ্ট হয়ে মৃত অবধি শামসুর রাহমানকে পড়েছি। শামসুর রাহমানের প্রতি ভালোবাসাই কখন যে তিনি প্রিয় হয়ে আমার মধ্যে আসন গেড়েছেন বলতে পারিনে। শামসুর রাহমান নামের কবিকে দেখায় নেশায় উদগ্রীব। ইতোমধ্যে শামসুর রাহমান খ্যাতির মধ্যগগনে। আমার জীবনে প্রথম ঢাকায় গমন। তিনি তখন দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদক। একা একাই তার অফিসে সাক্ষাৎপ্রাথীর্ হয়ে যাই। তার বসার কক্ষের প্রহরী বললেন অনুমতি ছাড়া দেখা করা যাবে না। আমি হতাশ হইনি। এক চিলতে কাগজে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। অনুমতি পেয়ে ভিতরে ঢুকে তার রূপ চেহারা দেখে মুগ্ধ। এরপর পৃষ্ঠা ৯-এ

৮ম পৃষ্ঠার পর

যেমন তিনি চেহারায় সুপুরুষ ও সুন্দর মনের তেমনি সুন্দর। বিস্কিট চা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। কবিতা লেখার কথা জানালাম। এ ঘটনা ১৯৭৭ সালে। তার শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি তখনই কেনা। জাতীয় কবিতা পরিষদ আন্দোলনে তার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়। তার সম্পাদিত একাধিক পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপা হয়েছে এজন্য আমি ধন্য। ১৯৯২ সালে অতিথি হয়ে জয়পুরহাট প্রেস ক্লাবে আসেন। তিনি জয়পুরহাট এসে আমাকে খেঁাজ করে নিয়েছিলেন। পৌরসভার দোতলায় একান্তে আমাকে নিয়ে আড্ডায় বসেছিলেন। ছবি তুলেছিলেন সে আড্ডার সাংবাদিক মোস্তাকীম ফাররোখ। আমার প্রিয় কবি প্রসঙ্গে গল্প পরিসরের এ নিবন্ধে সামগ্রিক শামসুর রাহমানকে রিপ্রেজেন্ট করা উদ্দেশ্য নয় এবং সেটা অসম্ভবের শামিল। তবে আমার কাছে কবি শামসুর রাহমান কেন প্রিয়? এ নিবন্ধে সে দাবি মেটাতে কবির কবিতা বা সৃষ্টি সম্পকের্ যত সামান্য আলোকপাত করা বাড়তি কোনো আবদার নয়। কবি হিসেবে আমার প্রিয় কবি বলার সদাথের্ মানসিক তাড়নাকে অবদমিত করে রাখা এখানে আত্মঘাতের শামিল হবে। সেই অপবাদ ঘোচাতে আমার দৃষ্টি সাচর্লাইটের আলো প্রিয় কবির প্রতি ফেলতে চাই। প্রথমত পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পযর্ন্ত সবার্ংশে শামসুর রাহমান একজন কবি। তিনি জনপ্রিয় কবি। জনতার কবি। দেশপ্রেমিক কবি। মৌলবাদবিরোধী কবি। জনতার আন্দোলনের পক্ষের কাতার বন্দি। মিছিলের প্রথম সারির কবি। মুক্তচিন্তার প্রগতির ধারক। সবোর্পরি পুরোমাত্রায় আধুনিক কবি। নিরহঙ্কার উদার প্রকৃতি প্রেম ও সময়ের রাজনৈতিক সচেতন প্রতিবাদী কবি। মাটি ও মানুষের কবি। এই বিশেষায়িত প্রতিটি বিশেষণ অকাট্য প্রমাণ তার সৃষ্টি থেকে তুলে ধরলে একেকটি বিশেষণে একেকটি অধ্যায় রচিত হবে। সবার উপরে শামসুর রাহমান স্বাধিনতাবিরোধী মৌলবাদীদের সম্মুখে সাক্ষাৎ খাপখোলা তলোয়ার। তাই এই অপশক্তি তাকে হত্যার জন্য হামলা চালিয়ে ব্যথর্ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। তখন দেখা গেছে শামসুর রাহমান এ দেশের মানুষের কাছে কতটা প্রিয়। মানুষ তাকে কতটা ভালোবাসে। এ দেশের আপামর জনতার হৃদয় আসনে ভালোবাসার অধিক প্রিয়। জীবদ্দশায় তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।

দেশপ্রেম প্রণয়কাতরতা উদারনৈতিক বিজ্ঞানমনস্কতা মানবিকতার নান্দনীয় বিভাসে উজ্জ্ব¡লতার কাব্যকলা। সমকালীন বাংলা কবিতার পরিমÐলে এই কবি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি অভিধার শিরোপায় ভ‚ষিত। এই কবি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান। স্বাধীনতা বিষয়টি তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিধায় তিনি স্বাধীন সাবের্ভৗম স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালি জাতির সাবর্জনীন প্রিয় কবি পুরুষ। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিপক্ষে মহান ভাষা আন্দোলনে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বদেশী স্বৈরশাসন ধমীর্য় মৌলবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসনীতির বিপ্রতীপ যুক্তিবাদিতায় তিনি ছিলেন সোচ্চার উচ্চকণ্ঠ অসীম সাহসী তার রচনাশৈলীতে। দেশপ্রেমের প্রণোদনায় উদ্দীপ্ত কবি পাকিস্তান জন্মের পর বাঙালির মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে রুখে উঠেছিলেন ‘দুখিনী বণর্মালা’ কবিতায়। রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ বীতশ্রদ্ধ স্বরূপতার মূলে চরম দুঃখবোধের যাতনা কবিকে আহত করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ববের্রাচিতভাবে নিবির্চারে গণহত্যার নৃশংসতায় অপরিমেয় দুঃখভারে তিনি ভারাক্রান্ত। মানুষের সৃষ্ট বিবেকবজির্ত দানবীয় অমানবিক গভীর দুঃখবোধ কবিচিত্তে ক্ষতের সৃষ্টি করে। তার অনেক কবিতার আঙ্গিকজুড়ে আছে সেই দুঃখবোধের প্রাচুযর্। অনাকাক্সিক্ষত অপ্রত্যাশিত বহুরৈখিক ঘটনা অনুঘটনার কাযর্করণ তার ব্যক্তিগত দৈশিক আন্তজাির্তক বেদনাদায়ক স্মৃতি অনুস্মৃতির আবেগ অশ্রæতে দানা বেঁধেছে কবির সৃষ্টকমের্ নিঃশব্দ শব্দের বুনোটে। দুঃখের সেই স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়েছে বিবিধ রূপব্যঞ্জনায়। তার নৈঃশব্দ্য চেতনা বিচ্ছিন্নতাবোধ দ্রোহ-প্রতিবাদ উচ্চকিত দুঃখবাদের সূচকে। সেই ঘণীভ‚ত রূপ কবিকে করেছে প্রতিবাদী ও জীবনবাদী। কখনো আশাবাদী হয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। আবার হতাশায় আক্রান্ত হয়ে দুঃখ উত্তরণে করেছেন আশাহত উচ্চারণ। জন্মভ‚মির প্রতি এই সচেতন ভ‚মিপুত্রের ভালোবাসা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তার কবিতার মমর্মূলে প্রোথিত। মানুষের প্রতি ভালোবাসার যে গান তিনি গেয়েছেন সে গান অনবদ্য মূছর্নায় নিরন্তর শুনি তার সুরধ্বনি। শুনছি শুনবো দেশবাসীর সঙ্গে আমিও। কারণ তার উচ্চারণ থেকে আমরা অবিচ্ছিন্ন জীবন লগ্নতায় একাত্মভাবে সন্নিবিষ্ট।

‘সবর্ত্রই দুঃখ নিজের নাম লিখে রাখে

আমাদের বারান্দার ঘরের চৌকাঠে

কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে

ছাদের কানিের্শ খরখরি ফ্রেমের বানির্শ মেঘের ধুলোয়

দুঃখ তার অঁাকে চকখড়ি এবং ধুলোয়’ (‘দুঃখ’ রৌদ্র করোটিতে)।

দুঃখবোধ বেদনাবোধের আরেক নাম বিষাদ। কবি দুঃখ বিষাদের উৎস সন্ধান করেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েই। দুঃখের উপ্তবীজ সম্পকের্ তার বলিষ্ঠ উচ্চারণ

‘সত্তায় এনেছি বয়ে অন্তহীন আশ্চযর্ বিষাদ

সেহেতু সে বিষাদের বৃন্তে ফোটে আতঙ্কের ফুল’ (প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে)

আমার প্রিয় শামসুর রাহমানের কাব্য আলোচনা মূল্যায়নের আলোকে এ নিবদ্ধের প্রাতস্বীকতায় সমুজ্জ্বল নয়। তবে কবি শামসুর রাহমান কেন প্রিয় আমার শুধু সে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে স্বল্প পরিসরে পাঠকের তৃষ্ণা মেটাতে এ প্রয়াস। মুক্তিযুদ্ধ তার কবিতার উল্লেখযোগ্য বিষয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদারদের ববের্রাচিত নিমর্মতা কবিকে ভীষণভাবে আহত করেছে।

‘দিনে দুপুরেই জিপে একজন তরুণকে

কানামাছি করে নিয়ে যায় ওরা

মনে হয় চোখ বঁাধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বদ্ধ ভ‚মিতে

বেয়োনেট বিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গা কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে

মনে হয় স্বাধীনতা লখিন্দর যেন বেহুলাবিহীন

জলের ভেলায় ভাসমান’

(স্বাধীনতা একটি বিদ্রোহী কবিতার নাম : দুঃসময়ে মুখোমুখি)

‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ (বন্দি শিবির থেকে) এ দুটি কবিতা লিখে শামসুর রাহমান সারাজীবন যদি আর কোনো কবিতা না লিখতেন তবে আব্দুর গাফ্ফার চৌধুরীর অমর একুশের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রæয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি লিখে যেমন অমর হয়ে রয়েছেন শামসুর রাহমানও

‘স্বাধীনতা তুমি রবীঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান

স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুলের বাবরি দোলানো ঝাকড়া এলো চুল’। (স্বাধীনতা তুমি)

‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা

আর কত কাল দেখতে হবে খাÐবদাহন’ (‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনত’)

এ কবিতার পাত্রমিত্র সবাই দুঃখময় প্রতীকে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সবাই প্রতিবাদী হয়েও দুঃখঘনিষ্ঠ অতীত। ‘আসাদের শাটর্’ কবিতায় গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের জন্য গণমানুষের দুঃখ শক্তিতে পযর্বশিত হয়েছে। ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতা আন্দোলনের অভিযাত্রার এক হাতিয়ার। জীবনের আলো অন্ধকারের আবাসভ‚মি কবি শামসুর রাহমানের কবিতা। তার কবিতার প্রাতস্বীকতায় উজ্জ্বলতর হয়েছে দুঃখবোধের নিবারিত স্বপ্নের ভেলা। উপেক্ষিত প্রবঞ্চক যুক্তিহীন অধিকার হরণকারীদের প্রতি চরম ঘৃণা তার দুঃখবোধের পরিসীমা বিশেষ নিবিের্শষ এবং ব্যক্তিক পারিবারিক সাবর্জনীন রাষ্ট্রিক আন্তজাির্তক। কালিকসীমা রেখা তিনি অতিক্রম করেছেন। বস্তুত তিনি ছিলেন বৈশ্বিক মানবিকবোধে উজ্জীবিত কবি। মানুষের দুঃখ-কষ্টকে ধারণ করেছেন নিজস্ব সংবেদনশীলতায়। কবি স্বভাবে এজন্য কালের ঊধ্বের্। লেখার পরিসর বৃদ্ধির কারণে এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু প্রিয় কবির উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ অনুপস্থিতির অভাবে পাঠকের কাছে লেখাটি মান ক্ষুণœতার পরিণত হবে। কবি শামসুর রাহমানের জন্ম বাংলাদেশের রাজধানীতেই শুধু নয়। সে রাজধানী মুঘল আমলেরও বটে। প্রাচীন এ শহরের একান্ত নিজস্ব মুঘল বাঙালির সংস্কৃতির প্রতিফলন রয়েছে তার কাব্যচচার্য়। নগরজীবনে বেড়ে ওঠায় নাগরিক চেতনা নাগরিক জীবনচিত্র তার কাব্যচচার্র অন্যতম উপজীব্য। বিধায় ‘নাগরিক কবি’ অভিধা তার প্রাপ্তিতে জুটেছে। সেই ঢাকা শহরের নিজস্ব চিত্রকল্প জীবনচিত্র তার কবিতায় স্বতঃস্ফ‚তর্ভাবে ফুটে উঠেছে। আরবি, ফারসি, ইসলামী শব্দের ব্যবহার সুফিবাদী ঢাকাইয়া শব্দের ব্যবহার তার কবিতার শুরু থেকেই পরবতীর্ অধর্শতাব্দীর কাব্যচচার্র মধ্য দিয়ে পূণর্তা পেয়েছে। মুঘল আমল থেকে ষাটের দশক পযর্ন্ত ঢাকার এটি ঐতিহ্য ছিল। জীবনে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়তো তা সবার্ংশে বিলুপ্ত হয়নি। প্রিয় কবির প্রিয় প্রাণী ঘোড়াকে নিয়ে কবিতা।

‘ঘোড়ার নালের মতো চঁাদ

ঝুলে আকাশের বিশাল কপাটে’ (জনৈক সহিসের ছেলে বলছে)

ঢাকায় বাতিওয়ালা ছিল পঞ্চাশের দশক অবধি। কবি সেই বাতিওয়ালাকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা।

‘তোমার পাড়ায় আজ বড় অন্ধকার

সম্ভবত বাতিটা জ্বালাতে ভুলে গেছ’ (‘শৈশবের বাতিওয়ালা আমাকে’)

এ কোনো আরোপিত কাব্যদশর্ন নয়। চেতনায় স্বতঃস্ফ‚তর্তায় শামসুর রাহমানের কাব্য দশের্ণ ঢাকা তার সহোদরা যমজ। যেমন ছিল শালর্ বোদলেয়র আর প্যারিস নগরী। চালর্স ডিকেন্স ও লন্ডন শহর। নাগিব মাহফুজ আর কায়রো ও মিজার্গালিব আর দিল্লি নগর। একে অপরের সমথর্ক। আদি ঢাকাইয়া ভাষায় রচিত তার কবিতা আমাদের মনপ্রাণ ছঁুয়ে যায়।

‘আসলে কেউগা আমি? কোন হালতে আইছি হালায়

দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ’ (‘এই মাতোয়ালা রাইত’)।

শামসুর রাহমান অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়িয়েছেন। স্বদেশ, সমাজ, দেশপ্রেম স্বদেশ চেতনায় সমৃদ্ধ তিনি স্বদেশী জয় গান মানবের বন্দনায় ছিলেন উজ্জীবিত। প্রেমাষ্পদকে নাগালে পাওয়ার আকুতি শূন্যতা মৃত্যুভীতি তার কবিতায় উপজীব্য ছিল। সময়কে কবিতায় ধরে রাখার ঐতিহাসিক চেতনায় শিল্প সফল উপস্থাপনা তার কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে বারবার। যার অন্যতম উদাহরণ স্বৈরাচার হটাও আন্দোলনের সময় রচিত ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ কাব্যগ্রন্থ।

কবিত্বের দম্ভে তিনি আকড়ে থাকেননি। আত্মপ্রসাদের উপাদান খেঁাজা কবির কাজ নয়। তার আরাধ্য শ্রম সামথর্্য সাধনা দ্বারা অভীপ্সার ঐকান্তিক উপলব্ধিতে শিল্প ও স্বভাবের প্রাকৃতিক প্রভেদ বুঝে অন্তিম তিমিরের সন্ধান লাভ। এ সাধনায় স্বতঃসিদ্ধ তার সারল্য ও শ্রম। আমার বিশ্বাস কবি প্রতিভার বিশ্ব মানবিক গুণাবলি প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় সুপ্রকট। নিজের অজ্ঞাতসারে দেখিয়েছেন যে তিনিও একজন মহৎ কবিদের পথিকৃৎ। মানুষের দুঃখ, বিপদ, মৃত্যু, আঘাত উত্তীণর্ হয়ে কবি শামসুর রাহমান সেই মানুষকে দেখতে পেয়েছেন। যিনি মানব অথচ ব্যক্তি মানুষকে অতিক্রম করে সদাজাগ্রত হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট। তিনি সাবর্জনীন মুক্তচিন্তার বিজ্ঞানমনস্কের সবর্কালীন একজন মানব। তিনি বিবেকবান মানব একই সঙ্গে বিশ্বমানব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<19344 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1