শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এক গ্রামে পানিতে ভাসমান দুই দ্বীপ

নতুনধারা
  ০৫ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

শামীম শিকদার

ইট বসানো আঁকাবাঁকা মেঠো পথের দুই পাশজুড়ে গাঢ় সবুজের মিছিল। গ্রামের বুক চিরে যাওয়া নির্জন একটি সড়ক গ্রামটিকে মিতালী করছে তিন উপজেলার সঙ্গে। এখানে প্রকৃতি যেন নিজেকে তার সব রূপ উজাড় করে দিয়েছে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্টে যায় রূপবৈচিত্র্য। গ্রামের পশ্চিমে রয়েছে পানির ওপর ভাসমান দুটি ভূখন্ড। সবুজ গাছে ঘেরা ভূখন্ড বা দ্বীপের চারদিকে পানি থই থই করে। দুই দ্বীপে অন্তত ৩০টি পরিবার বাস করে। এখানেই রয়েছে ১০ শতাংশ জায়গার ওপর প্রায় শত বছরের পুরনো একটি আমগাছ। গ্রামের মানুষ কখনো কৃষক, কখনো জেলে আবার কখনো মাঝি। এমন একটি গ্রামের নাম দমদমা। যা কাপাসিয়া, শ্রীপুর ও কালীগঞ্জ তিন উপজেলার মোহনায় অবস্থিত।

যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে তিন উপজেলার সঙ্গেই গ্রামের মানুষের নিবিড় সম্পর্ক। তার মধ্যে কাপাসিয়া অন্যতম। কাপাসিয়া সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এ গ্রামের চারদিকে পাখির কলতান। কখনো কখনো সুনসান নীরবতা; যেন এক্ষনি কেউ এসে ধরে নিয়ে যাবে। পথ দিয়ে একা একা চললে দুর দুর করে উঠবে বুকের ভেতরটা।

গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি হলেও এখানকার বৃহৎ অংশই প্রবাসী। স্থানীয় একটি দাখিল মাদরাসা ছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় শিক্ষাব্যবস্থার তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। গ্রামের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা সড়কগুলোতে ইট বসানো। আবার কোথাও কোথাও কাঁচা সড়কও রয়েছে। হাট-বাজার বা দোকান-পাট দূরে হওয়ায় মানুষকে কষ্ট পোহাতে হয়। গ্রামের ভিতরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে পানির মধ্যে ভাসমান দুটি দ্বীপ। যেখানে কয়েকটি পরিবার মিলেমিশে বসবাস করে। শুধু দুটি দ্বীপই নয়- এখানে আরও অনেক দ্বীপ বর্ষার ভরা মৌসুমে টইটম্বুর পানিতে মাথানাড়া দিয়ে জেগে ওঠে। আকর্ষণীয় ভাসমান দ্বীপ দুটি মৃধাবাড়ি নামে পরিচিত। বর্ষার ভরা মৌসুমে চারপাশে থই থই পানিতে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের মতো ভেসে থাকে ভাসমান এ ভূখন্ডটি। কয়েক বছর আগেও বর্ষা মৌসুমে সেখানে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল ছোট ডিঙি নৌকা। অর্ধ কিলোমিটার দূর থেকে ইশারার মাধ্যমে সংকেত দিয়ে চলাচল করত মানুষ। মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে কয়েক বছর আগে ছোট একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ করার সে চিত্র কিছুটা পাল্টে গেছে। তবে এখনো পাল্টেনি গ্রামের মানুষের কর্মব্যস্ত জীবন।

বর্ষায় গ্রামের কৃষকরা হয়ে ওঠে জেলে। সারাদিন চলে মাছ ধরার ধুম। সন্ধ্যায় বাড়ির পাশে পাতা হয় মাছ ধরার জাল। জালে ধরা পড়া মাছ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ডিঙি চালাতে পারে পরিবারের এমন যে কেউ। পানি থেকে তোলা হয় লাল-সাদা শাপলা ফুল। বাড়িতে রান্না করা হয় সে ফুল। মাঝেমধ্যে বাজারেও বিক্রি করা হয়। পানি কমতে শুরু করলে ছোট-বড় ডোবা ও খেত থেকে সেচ দিয়ে মানুষ মাছ ধরতে শুরু করে। জমিতে ধানগাছ রোপণের উপযোগী করার জন্য পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানা জমাট বেঁধে উপরে তোলে গ্রামের কৃষকরা। ওই সময় মাছ খেতে হাজার হাজার সাদা বকের দল ভিড় জমায়। সন্ধ্যা হলে দ্বীপের বাঁশঝাড়ে তারা বাসা বাঁধে। তখন গ্রামের ছোট ছেলেরা ছিমছাম রাতের অন্ধকারে বক শিকারে বাঁশঝাড়ে লাইট নিয়ে ঘোরে। এক দ্বীপে বকের ডানার ঝাপটানি, অন্যটিতে পাখির কিচিরমিচির কলতানে মনে হবে দুটি দ্বীপই যেন পাখিরা শাসন করছে। তবে তাদের মনে বড্ড ভয়। মানুষের আওয়াজ পেলেই ফুড়ুত করে উড়ে যায়। এখানেই রয়েছে বিশাল বড় আকারের একটি আমগাছ। গাছটির মালিক নূরউদ্দিন মৃধা। তার কাছ থেকে জানা যায়, প্রতি বছর এই গাছের আম একবারে পাইকারদের কাছে ২০-২৫ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। খুচরাভাবে নিজে বিক্রি করলে অনেক বেশি টাকা বিক্রি করা যাবে বলে তার দাবি। কত পথিক তার ক্লান্তির অবসান খুঁজেছে এ গাছের ছায়ায় তার হিসাব নেই। কঠোর পরিশ্রমের পর বা তীব্র রোদে এ গাছের নিচে বসে মানুষ প্রশান্তি খোঁজে। বসার জন্যও রয়েছে সুব্যবস্থা।

বৈশাখে পুরো গ্রামজুড়ে লাগে ধান মাড়াইয়ের উৎসব। পরিবারের সবাই মিলে সারাদিন রোদে পুড়ে বা বৃষ্টিতে ভিজে মাঠ থেকে গোলায় ধান তোলে। একজন কৃষক ২০০ থেকে ৩০০ মন ধান পায়। গোলা ভরে যায় ধানে। কৃষকের সারা বছরের সব ক্লান্তি ভুলে মুখে ফুটে ওঠে হাসি। গোলা থেকে অল্প অল্প করে ধান বিক্রি করে চলে সংসার ও সন্তানের পড়ালেখার খরচ। শীতে কৃষাণিরা ব্যস্ত থাকে বাড়ির পাশে সবজি চাষে। কৃষকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে খেজুর বা তালগাছের রস সংগ্রহ করার কাজে।

শিল্পীর নিজের হাতে আঁকা ছবির মতো গ্রাম যেন দমদমা। প্রকৃতি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে এখানে। প্রকৃতিপ্রেমী যে কোনো ব্যক্তিকেই বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকবে এ গ্রামের মনোমুগ্ধকর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশ। গ্রামের মানুষের অতিথি পরায়ণতাও যেন কোনোভাবে ভোলার মতো নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<82940 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1