শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিড়ালের মাছ পাহারা এবং দায়সারা তদন্ত কমিটি

ধষর্ণ যেহেতু নারী-পুরুষ দ্বিপক্ষীয় এবং অত্যন্ত স্পশর্কাতর ও সংবেদশীল; সেহেতু তদন্ত কমিটি হওয়া উ?চিত নারী-পুরুষ উভয়কে নিয়ে। অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের বাইরের তৃতীয় কোনো পক্ষ নিয়ে, যারা বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৃত অথের্ই অন্যায়ের প্রতিকার চান।
মুশফিকা লাইজু
  ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

ধষের্ণর তদন্ত যখন ধষর্করাই করেন ধষির্তা তখন আরো একবার প্রকাশ্যে ধষির্ত হন। এরপরও চলে দফায় দফায় ধষর্ণ। একবার পাড়া-প্রতিবেশী, একবার মিডিয়া, একবার প্রশাসন, একবার সন্দেহবাদী ও অবিশ্বাসীরা। আর শেষে পুরো হত্যার শিকার হন যখন জল্পিত-কল্পিত মনগড়া তদন্ত রিপোটর্ প্রকাশিত হয়। একটি অসম্মানের দৌড় শেষ মাথায় এসে অন্ধকারে তলিয়ে যায়, নিযাির্ততা জীবনমৃত হয়ে শুধু রেফারেন্সে ও গবেষণায় বেঁচে থাকে। পুরো দেশে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে নারী অবমাননা তথা ধষের্ণর ঘটনা। আমরা শুধু নাগরিকরা জানতে পাই, প্রচার মাধ্যমগুলো যে কয়টা জানাতে চায় সে কয়টাই। তার মধ্যে লঘু-গুরুর মাত্রা নিধার্রণ তো হয়ই। যেমন রাজনৈতিক ধষর্ণ, অথৈর্নতিক বৈষম্যের ধষর্ণ, দুবর্লকে নিপীড়নের নিমিত্তে ধষর্ণ, মৌজমাস্তির ধষর্ণ, আরো নানাবিধ অগণিত কারণে বাংলাদেশে ধষের্ণর মতো নৃশংস ঘটনা ঘটে থাকে। শুধু বাংলাদেশ কেন, পুরো পৃথিবীতেই তো এ ধরনের সহিংসতা চলছে। যেহেতু ধষের্ণর সব দায় নারী বা নিপীড়িতের ওপরেই পড়ে, তাই নিতান্ত প্রাণ-সংহারের কারণ না হলে ধষের্ণর ঘটনা খুব একটা জনসমক্ষে আসে না। তবুও কিছু দুঃসাহসী আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারীরা যখন আগামী পৃথিবীর মঙ্গলহেতু তাদের প্রতি নিযার্তনের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরেন তখনই শুরু হয় সত্য প্রমাণের অগ্নিপরীক্ষা। হাজার পাওয়ারের ফোকাস লাইটের সামনে র‌্যাম্প মডেলদের মতো এদিক-ওদিক করে তাকে প্রমাণ করতে হয় যে ঘটনা সত্য। কোনো এক শিশ্নযাতনাকারী ইতরপুরুষ ব্যাধের কাছে সে বধ হয়েছে। লুণ্ঠিত হয়েছে তার সম্মান-সম্ভ্রম। সভ্যতার কাছে সে অসহায়ভাবে শিকার হওয়া এই নিমর্ম ববর্রতার প্রতিকার চায়। তখন থেকেই শুরু হয় তদন্ত কমিটির তদন্ত। পরবতীর্ সময়ে কষির্ত হয় ধষিের্তর রিপোটর্। এই যেমন হয়েছে এক নারী ভারোত্তোলকের ক্ষেত্রে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এক অফিস সহকারী সোহাগ মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে এক নারী ভারোত্তোলককে ধষর্ণ করার। জাতীয় ক্লাব ভারোত্তোলনে সোনাজয়ী এই নারী ভারোত্তোলক ঘটনার পর থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসাও নেন। নিযাির্তত ভারোত্তোলকের মা জানান, গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরনো ভবনের চতুথর্ তলায় ধষের্ণর শিকার হন তার মেয়ে। তিনি বলেন, ১৫ সেপ্টেম্বর খেলা ছিল। তাই ১৩ সেপ্টেম্বর অনুশীলনের জন্য ডেকে আনা হয় সেই ভারোত্তোলককে। পুরনো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চারতলায় ডেকে এনে সেই ভারোত্তোলকের সম্ভ্রমহানি করে সোহাগ আলী। আর সেই মেয়েকে রুমে নিয়ে আসতে সহায়তা করে একই ফেডারেশনের কমর্চারী মালেক ও আরেকজন নারী ভারোত্তোলক। এমনই অভিযোগ নিযাির্ততা সেই নারী ভারোত্তোলকের মায়ের। খেলা থাকলে ঢাকার বাইরে থেকে আসা খেলোয়াড়রা সাধারণত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে অবস্থান করেন। ভারোত্তোলকের মায়ের তথ্যমতে, ঘটনাটি তারা জেনেছেন অনেক পরে। বাড়ি ফেরার পর হতাশাগ্রস্ত নারী ভারোত্তোলক ব্যাপারটি কাউকে বলেননি। ঘটনার পর গত ১০ অক্টোবর তিনি বাড়ির পেছনের পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। আত্মহত্যার চেষ্টা চালানোর পর থেকে গ্রামে কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা চলছিল সেই নারীর। শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হলে ২৩ অক্টোবর গ্রাম থেকে ঢাকায় এনে মানসিক হাসপাতালের আইসিইউতে ভতির্ করে চিকিৎসা করানো হয়। আর নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বিষয়টি জানাজানি হলে, খবরটি দেশের সব শীষর্স্থানীয় জাতীয় পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। তাতে টনক নড়ে ভারোত্তোলন ফেডারেশনের। তখন ফেডারেশনের পক্ষ থেকে জাতিকে জানানো হয় দুই দফা তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা। আরো জানানো হয়, দ্রæতই সুষ্ঠু তদন্ত করে রিপোটর্ পাওয়ার পর আইন অনুযায়ী অপরাধীর বিচার হবে। যেহেতু ওই ক্রীড়াবিদ জাতীয় ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জয়ী। বড় ক্রীড়াবিদ হওয়ার হাতছানি তার সামনে, দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগও ছিল তার। তাই ভেবেছিলাম, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। আমরা সাধারণ নাগরিকরা (নারী) অপেক্ষা করছিলাম, আশা করেছিলাম যে, এবার একটা দৃষ্টান্তমূলক কিছু হতে যাচ্ছে। কারণ সেই ক্রীড়াবিদের সম্ভাবনা ছিল আন্তজাির্তক অঙ্গনে দেশের ভাবমূতির্ উজ্জ্বল করার। কিন্তু হায়, ‘সকলি গড়ল ভেল’। সময় চলে যায় সময়ের উল্টো পথে। এ ঘটনার প্রতিবাদে প্রায় দেড়মাস পর দেশসেরা সাবেক নারী ক্রীড়াবিদ কামরুন নাহার ডানার নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা হয়। তারও এক মাস পরে প্রকাশ করা হয় প্রহসনের তদন্ত রিপোটর্। তাতে অপরাধীকে আড়াল করতেই যেন প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ঐ নারী ধষির্ত হওয়ার একমাস পর কেন অভিযোগ করেছিল? ধষের্ণর ঘটনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন এনএসসির পুরনো ভবনে ওই নারী ভারোত্তোলকের উপস্থিতিও হয় প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও ধষের্ণর শিকার হওয়া নারী আরো দুজন প্ররোচনাকারীর নামও উল্লেখ করেছিলেন, তথাপি তাদের বক্তব্য প্রছন্ন রাখা হয়। শেষে বলা হয়, ধষর্ণকারী এবং ধষির্তা দুজনই কমিটির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এবং কমিটি আরো একমাস সময় চেয়েছে, আরো বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি ‘আগডুম বাগডুম ব্যাপার’। তদন্ত কমিটির প্রধান যখন টেলিভিশনে বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন তার আচরণ প্রকাশ এমন ছিল যে, এটা এমন কি গুরুত্বপূণর্ ব্যাপার!! সামান্য একটা ধষর্ণ বই তো অন্যকিছু নয়। বোঝা যাচ্ছিল, আমাদের ধৈযর্ পরীক্ষা নেয়ার পর তদন্ত কমিটি নিযাির্ততাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার জন্য আরো যুতসই কিছু প্রমাণ আমদানি করে দীঘর্ ‘সীতা কাহিনী’ প্রকাশ করবার পঁায়তারা করছেন। আর ততক্ষণে ওই ভারোত্তোলক নারী ভারবাহী হয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ক্রীড়া জগত থেকে আড়ালে চলে যাবেন। অকালেই হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম দেশের এক প্রতিভা। কোনো ধষর্ণ সংঘটিত হলে, আমাদের দেশে যা প্রচলিত তা হলো বিনা বাক্য ব্যয়ে ঘটনার সমাধি রচনা করা। দ্বিতীয়ত, জনগণের চোখকে ধূমায়িত করার জন্য তদন্তের নামে স্বগোত্রীয় (পুরুষ) সদস্যনিভর্র একটা কমিটি করা। যারা মূলত ধষের্ণর কারক স¤প্রদায়। ইহজীবনে কেউ ধষর্ণ করুক বা না করুক, ধষর্ণকে কিংবা ধষের্ণর কাহিনীকে তারা বিকৃতভাবে উপভোগ করে। সবোর্পরি তারা প্রত্যেকেই ধষর্কামী। পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে গো?ত্রের সম্মান রাখার জন্য মরিয়া। যখন এই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কাযর্ক্রম পরিচালনা করে তখন কোথাও একটা খচখচানি অনুভব করে। স্বগোত্রের প্রতি মমতা অনুভব বিচিত্র কিছু নয়, যেখানে ন্যায়-অন্যায় বোধ গৌণ হয়ে যায়। আমরা জানিই না যে ধষের্ণর মতো স্পশর্কাতর একটা বিষয়ের তদন্ত করার মতো ওনারা যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত কিনা, পূবের্র কোনো তদন্ত পরিচালনার দক্ষতা তাদের আছে কিনা। কমিটির সদস্যরা নারীবান্ধব কিনা। কেবল সংগঠনের ক্ষমতায় আছেন বলে, প্রতিষ্ঠান-প্রধান বলেই তিনি তদন্ত কাজ পরিচালনা করবেন? ব্যাপারটা এমন যেন কোনো প্রকল্প পরিচালনার সভা। ধষর্ণ যেহেতু নারী-পুরুষ দ্বিপক্ষীয় এবং অত্যন্ত স্পশর্কাতর ও সংবেদশীল; সেহেতু তদন্ত কমিটি হওয়া উচিত নারী-পুরুষ উভয়কে নিয়ে। অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের বাইরের তৃতীয় কোনো পক্ষ নিয়ে, যারা বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৃত অথের্ই অন্যায়ের প্রতিকার চান। বাংলাদেশে ধষের্ণর ক্ষেত্রে শতকরা ৯৯ ভাগ তদন্ত কমিটি হয় শুধু পুরুষ সদস্যনিভর্ও এবং তারা প্রধানত প্রত্যেকেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কমর্রত ঊধ্বর্তন ব্যক্তি। তাতে তদন্ত কমিটির রিপোটর্ আর বানরের পিঠাভাগ সমাথর্ক হয়ে উঠে। পরিতাপের বিষয়, এসব যেনতেন হাবজাবা তদন্ত কমিটি সাধারণত ধষের্ণর ঘটনার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। তবে সোনা চুরি, ব্যাংকলুট ইত্যাদির ক্ষেত্রে নয়। নারীকে অবদমিত, অপমাণিত, পরাজিত ও অসম্মানিত করার ক্ষেত্রে এটি পুরুষতন্ত্রের হীন ও অব্যথর্ এক অস্ত্র। নিজের স্নায়ুকে আর কতটা ভেঁাতা করলে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নিজীর্ব হয়ে পড়ে থাকতে পারব কি, জানি না। প্রতিদিন নতুন এক একটা ধষের্ণর খবর আর তার নিবির্কার-নিির্বর্চার সমাধান মানব সভ্যতাকে কতদিন কলঙ্কের হাত থেকে আড়াল করে রাখবে, জানি না। তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জিজ্ঞাসা, ‘যাহারা তোমার বিষাইয়াছে বায়ু, নিভাইয়া?ছে তব আলো। তুমি কি তাদের করিয়াছ ক্ষমা, তুমি কি বেসেছ ভালো?’ মুশফিকা লাইজু: উন্নয়ন কমীর্

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে