মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বোরো আবাদে মহাপরিকল্পনা

আলতাব হোসেন
  ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৪৬

চলতি বোরো মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। বোরো আবাদে সেচকাজে বিদ্যুৎ, সার ও ডিজেল ব্যবস্থাপনায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি সার ও ডিজেলের পর্যাপ্ত মজুদ গড়ে তোলা হচ্ছে। চোরাচালান, সার ও ডিজেলের ডিপোতে নাশকতা ঠেকাতে নজরদারি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সীমান্তে বর্ডার গার্ডকে সতর্ক থাকতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেচকাজে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে প্রয়োজনে শহরে লোডশেডিং করে কৃষিকাজে বিদ্যুৎ রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় পর্যালোচনা সভায় ১৭টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সারা দেশে বোরো ধান আবাদের প্রস্তুতি চলছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই কোমর বেঁধে ফসলের মাঠে নেমে পড়ছেন কৃষকরা। কুয়াশায় ঢাকা শীতের সকালে বীজতলায় ধানের চারা পরিচর্যার পাশাপাশি জমি চাষের কাজ চলছে পুরোদমে। ধানের এলাকা হিসেবেখ্যাত হাওড় অঞ্চলে চলছে বোরো আবাদের ধুম। নেত্রকোনা, জামালপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, মাগুরা, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো ও ময়মনসিংহের কৃষকরা প্রচণ্ড শীত ও হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে বোরো ধান রোপণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলম, পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধŸতন কর্মকর্তারা জানান, এবার সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে দুই হাজার মেগাওয়াট। মৌসুমের শুরুতেই সার ও বীজ ধান ও সেচের প্রয়োজন হয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চলে বোরো আবাদে সেচের জন্য বিদ্যুতের পিক পিরিয়ড।

আন্তঃমন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসন্ন ২০২৪ সালে সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের সামগ্রিক চাহিদা ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত সেচ মৌসুমের এপ্রিল মাসে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এ হিসাবে চাহিদা বাড়বে ১ হাজার ৮ মেগাওয়াট। বলা হয়েছে, বর্তমানে মোট সেচ সংযোগের সংখ্যা ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৮৫১টি এবং অপেক্ষমাণ আবেদন সংখ্যা ৯ হাজার ৪৩২টি। শুধু সেচের জন্য চলতি জানুয়ারি মাসে ৩৪৭ মেগাওয়াট, ফেব্রুয়ারি মাসে ৮৬৫ মেগাওয়াট, মার্চ মাসে ১ হাজার ৯৪৯ মেগাওয়াট, এপ্রিল মাসে ১ হাজার ৯৮৯ মেগাওয়াট এবং মে মাসে তা আরও বেড়ে ২ হাজার ৫৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা হবে।

এ চাহিদা পূরণে গ্যাসের চাহিদা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট যা ন্যূনতম ১ হাজার ৫৪০ মিলিয়ন ঘনফুট হতে পারে। এ ছাড়া ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫০ টন এবং ডিজেলের চাহিদা ১৫ হাজার ৬০০ টন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে জানানো হয়, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের কোনো ঘাটতি নেই এবং চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করা হবে।

আসন্ন সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলা হয়। পিক-আওয়ার পরিহার করে রাত ১১টার পর থেকে পরের দিন সকাল ৭টা পর্যন্ত অফ পিক-আওয়ারে সেচ পাম্প ব্যবহারের বিষয়ে কৃষকদের মধ্যে প্রচারণা চালানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সঞ্চালন লাইনের প্রয়োজনীয় মেরামত বা সংস্কার করাসহ সেচ কার্যক্রম পরিবীক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিতরণ সংস্থা ও কোম্পানিসমূহে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলার কথাও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া সেচ মৌসুমে জ্বালানি পরিবহণের ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয় সে বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ, বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএ ও বিপিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বাবিউবো) পক্ষ থেকে যোগাযোগ রক্ষা করে জ্বালানি পরিবহণ নিশ্চিত করা; সেচ পাম্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গ্রিড উপকেন্দ্র, সঞ্চালন লাইন, বিতরণ লাইন ও উপকেন্দ্রগুলো সংরক্ষণ ও মেরামত কাজ জরুরি ভিত্তিতে সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে।

ওভারলোডেড সাবস্টেশনসমূহ ও সঞ্চালন লাইনের আপ-গ্রেডেশনের কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করাসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে ন্যূনতম ২ মাসের উৎপাদন ক্ষমতা রাখার জন্য জ্বালানি তেলের মজুদ নিশ্চিতকরণ, সেচ পাম্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ তদারকির জন্য মনিটরিং কমিটি গঠন এবং মনিটরিং কমিটির কার্যক্রম জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার ও ডিজেলের ডিপোগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সরকার এ সময়টায় প্রয়োজনে শহরে লোডশেডিং করে সেচের জন্য গ্রামে বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে বছরে সারা দেশে ২৫ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বোরো মৌসুমের জন্য প্রয়োজন হয় ১৩ লাখ ১৯ হাজার ৪৯১ টন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় তিন লাখ ৯৬ হাজার টন। ফেব্রুয়ারিতে সার লাগে ৪ লাখ ১১ হাজার টন আর মার্চ মাসে প্রয়োজন পড়বে দুই লাখ ২৩ হাজার টন। ইতিমধ্যে সরকার বোরো মৌসুমের জন্য ১৫ লাখ টন সারের মজুত করেছে।

কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ডিজেল ও সার পাচাররোধে বিজিবিসহ সীমান্ত এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। সরকার বোরো উৎপাদনে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংস্থা একসঙ্গে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে মনিটরিং সেল খোলা হচ্ছে। মাঠ ও আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা মাঠে অবস্থান করে তদারকি করার তালিকা করার প্রস্তুতি চলছে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন বিভাগের পরিচালক তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী যায়যায়দিনকে বলেন, এবার ৫০ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর এলাকায় বোরো আবাদ হবে। এ থেকে উৎপাদনের টার্গেট ধরা হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ টন। এবার বোরো মৌসুমে উচ্চফলনশীল জাতের ধানের আবাদ বাড়ানো হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত হাওড় এলাকায় ২৪ শতাংশ জমিতে বোরো রোপণ করা হয়েছে। সারা দেশে বোরো রোপণে কৃষকরা মাঠে নেমেছেন। সম্প্রসারণ কর্মীরা কৃষকদের পাশে মাঠে আছেন। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে এবার বাম্পার ফলন হবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে