মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় আলুর নাভি ধসে আতঙ্কিত কৃষক

বগুড়া প্রতিনিধি
  ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১৭:৩২

কৃষকদের হাসি নেই বিখ্যাত আলুর মাঠগুলোতে, এখন শুধুই মলিন মুখে চিন্তার ছোপ। দিন যতই যাচ্ছে বৈরী আবহাওয়ার কারণে আলুর ক্ষেতে রোগবালাই ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাজ। তাদের হাজারো স্বপ্ন এখন পচে যাচ্ছে। বগুড়ার শত-শত হেক্টর জমির আলুগাছ ধিরে ধিরে নেতিয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে পাতাগুলোতে পচন ধরে বেশিরভাগ ঝরে গেছে। কৃষকরা তাদের নিজেদের কৌশল, শ্রম ও কৃষিবিভাগের সহযোগিতা ছাড়াও বিভিন্ন নামি বেনামি কোম্পানির লোকদের পরামর্শ ও নানারকম ঔষধ ছিটিয়ে নিজেরাই নাজেহাল হয়ে পরেছে।

মানসিকভাবে তারা এখন অনেকটাই দুর্বল। অনেকেই আশা ছেড়েই দিয়েছে, প্রতি বিঘায় প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে শুন্যহাতে ঘড়ে ফিরতে হবে এমন চিন্তায় তারা নিজেকে অসহায় ভেবে নিজ পরিবারের কাছে আবেগ ও আক্ষেপ ছাড়া কিছুই করতে পাচ্ছেননা।

শস্যভান্ডার খ্যাত বগুড়া আলু চাষে দেশের অন্যতম। ওখানকার আলু নিজেদের চাহিদা পুরনের পরেও প্রায় ১০ লক্ষ মেট্রিকটন দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। জাত ভেদে স্বাদের আলু চাষ হয়ে থাকে বগুড়াতেই। আলু মজুদের দিক থেকেও কম নয়। অর্থাৎ সংকট মুহুর্তে বগুড়ার আলুর উপর নির্ভর করে দেশের বাজার।

২০১৮ সালে আলু চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছিল কৃষকরা, তবে কৃষকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের পকেটটাই বেশি ভাড়ি হয়েছিল। এর পর ২০২৩ সালে অস্থির হয়ে ওঠে আলুর বাজার, যার প্রভাব ২০২৪ সালেও কিছুই কমেনি। এমন বাজার দেখে এবার বগুড়ার আলু চাষীরা একটু বেশিই ঝুকে পড়ে। অর্থাৎ গতবছর জেলায় আলু চাষ হয়েছিল ৫৩ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে এবার চাষ হয়েছে ৫৫ হাজার ২৬০ হেক্টর।

বিগত দিনের চেয়ে আলু চাষে খরচ বেড়েছে অনেকটাই বেশি। এরই মধ্যে নানা ধরনের রোগের কারনে কিটনাশক ও পচন নিবারক ঔষদ ব্যবহার করে দ্বিগুন খরচ হয়ে যাচ্ছে।

এতে লাভতো দুরের কথা আক্রান্ত জমিগুলো থেকে প্রতি বিঘায় ১০-২০মন আলু পাওয়াটাই কৃষকদের ভাগ্যের বেপার। বগুড়ার জমিগুলোতে ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘায় ৮০ থেকে ১০০ মন পর্যন্ত আলু হয়ে থাকে। কিন্তু নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় এবার বিঘায় কত মণ হবে তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

উপসি জাতের গাছগুলোতে সবেমাত্র শিকর থেকে আলু বের হয়ে মার্বেল আকৃতির হয়েছে। এসব আলু পরিপক্ক হতে আরো প্রায় ২০ থেকে ৩৫ দিন সময় লাগবে। এরই মধ্যে ভয়ঙ্কর রুপে হানা দিয়েছে নেটব্লাইট (নাভি ধস) রোগ। এই রোগে গাছের পাতা পুরে ও পচে যাচ্ছে। যা থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোন সুযোগ নেই কারন এক রাতেই এই রোগ যেসব জমিতে আক্রমন করেছে সেসব জমিতে ঔষধ স্প্রে করে আর কোন কাজ হচ্ছেন। কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যানুযায়ী প্রায় একশো ২০ হেক্টর জমিতে এই রোগ দেখা দিয়েছে।

আলু একটি সংবেদনশীল ফসল অর্থাৎ বীজ লাগানোর পর থেকে নানা ধরনের প্রতিকূলতা পেরিয়েই ঘরে তোলা সম্ভব। একটু এদিক সেদিক হলেই মস্তবড় বিপদ কাঁধে চাপে কৃষকদের। এরকমটাই হয়েছে এবার বগুড়ায়। চলমান গড়মের মাঝেই হঠাৎ একরাতের অস্বাভাবিক ঠান্ডায় শত-শত জমিতে দেখা দেয় নেটব্লাইট (নাভি ধস) নামের এই রোগের আক্রমন।

সরেজিনে শিবগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু কৃষকের সাথে কথা বললে তারা উক্ত ঘটনার কথাই জানায়। এদের মধ্যে চকভোলাক এলাকার মজিবর রহমান নামের এক কৃষক তার আঞ্চলিক ভাষায় বলেন এক রাতের শিতলী ঘোড়ায় এই রোগ দেখা দেয় অর্থাৎ সারাদিন গরমের পরে রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা হওয়ায় আমার দুই বিঘা মাটিতে এই রোগ দেখা দেয়। আমি ৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলাম। এটা দেখার পর ঐ দিন সকাল থেকেই ঔষধ ছিটাতে শুরু করি এতে অন্য ৩ বিঘার আলুর গাছ ঠিক আছে।

এতে করে আমি মনে করি প্রথম থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করে ঔষধ প্রয়োগ করলে এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তিনি আরো বলেন নিজেদের রাখা বীজের চেয়ে অফিস থেকে বীজ সংগ্রহ করে চাষাবাদ করলে এই রোগ কম হয় এবং ফলনও ভালো হয়। তবে বিএডিসি থেকে নেয়া বীজে এবার এই রোগ বেশি হয়েছে।

নন্দীগ্রাম উপজেলার খরনা ইউনিয়নের বেশকিছু কৃষকের সাথে কথা বললে তারাও একই কারণ বলেন এদের মধ্যে খরনা এলাকার গোলাম মোস্তফা নামের এক কৃষক বলেন বেশি ঠান্ডা এই রোগের আসল কারন নয়। গরম থেকে হঠাৎ ঠান্ডা আবহাওয়া হওয়ায় একরাতেই এই রোগ দেখা দেয়। তিনি বলেন প্রথমে দু একটি পাতাতে পাচারি দেখা দেয় এর পর দু-চার দিনের মধ্যেই পুরো জমিতে ছরিয়ে পরে। তিনি আরো বলেন এই রোগ এক জমি থেকে অন্য জমিতেও ছড়ায় অর্থাৎ কোন জমিতে দেখা দিলে তাৎক্ষনিকভাবে আশে-পাশের জমিতে ঔষধ প্রয়োগ করলে এই পচারি রোগ থেকে মুুক্তি পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ মতলুবর রহমান বলেন। বিগত কয়েকদিনের বৈরি আবহাওয়ার কারনে আমাদের আলুতে লেটবøাইট বা নাভি ধসা আক্রমনের দখো দেয়। তবে আমরা প্রথম থেকেই কৃষক ভাইদের পরামর্শ দিয়ে আসছি যে, এই ছত্রাকজনিত রোগ যেনো না ক্ষতি করতে পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এবং মেনকোজেব নামের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে প্রতি শতাংশ জমিতে ২ লিটার হারে গাছের পাতার উপরে ও নিচে এছাড়া ডগা পর্যন্ত যেনো পৌছায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে স্প্রে করতে হবে। আমরা সাধারণত প্রতি সপ্তাহে একবার স্প্রে করার পরামর্শ দিয়ে থাকি কিন্তু যখন একেবারেই বৈরি আবহাওয়া দেখা দেয় তখন প্রতি ৪-৫ দিন পর-পর স্প্রে করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দুই হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে তাই যে পরিমান জমিতে এই রোগ দেখা দিয়েছে তাতে তেমন কোন প্রভাব পরবেনা বলে আমরা মনে করছি।

এছাড়ও আলু চাষে আমাদের দেয়া পরমর্শ অনুযায়ী কৃষকদের আরো সতর্ক ও যত্নশীল হতে হবে। তাহলেই ভালো ফলন পেয়ে কৃষকরা লাভোবান হতে পারবে।

বগুড়ায় ইতিমধ্যে জমি থেকে আলু সংগ্রহ শুরু হয়েছে এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির আলু উত্তলন করা হয়েছে। আগমি ১৫-২০ দিনের মধ্যে পুরো দমে আলু তোলার কাজ শুরু হয়ে যাবে। বিগত কয়েক বছরের চেয়ে এবার আলু গাছের চেহারা অনেকটাই ভালো এতে করে কৃষকরা আশা করছেন আগামির এই কয়েক দিন যদি রোগ-বালই থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তাহলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।

কৃষকদের দেয়া তথ্যনুযায়ী এবার প্রতি বিঘা আলুতে ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে এক বিঘা জমিতে ১৫-২০ হাজার টাকার বীজ, প্রায় ১০ হাজার টাকার সার, চাষ ও শ্রমীকের মজুরী প্রায় ১০ হাজার ও ৭-১০ হাজার টাকার ঔষধ ছিটাতে হচ্ছে।

এছাড়া বেশিরভাগ কৃষক জমি পত্তন নিয়ে চাষাবাদ করে থাকে। এসব জমি প্রতি ১ বিঘা বছরে ১৫-২০ হাজার টাকা পত্তন দিতে হয়। এক বিঘা জমি থেকে ভালো ফলন হলে ১০০ মন আলু পাওয়া যায়। এতে প্রতিমন আলু ৮০০ টাকা দরে বিক্রয় না করতে পারলে লাভ হয়না। কৃষকরা বরেন প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা ধরনের রোগ-বালাই আছেই অর্থাৎ অনেক বড় ঝুকি নিয়েই আলু চাষ করতে হয়।

বগুড়ায় আলু চাষে বিক্ষাত উপজেলা হিসেবে শিবগঞ্জকেই চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া উল্লেখযোগ্য হিসেবে নন্দীগ্রাম, কাহালু, সাজাহানপুর, শেরপুরসহ প্রত্যেক জেলাইতেই আলু চাষ হয়ে থাকে। জেলায় এবার উপসি জাতের মধ্যে সবথেকে বেশি চাষ হয়েছে এষ্টারিক্স। এই জাতের আলু চাষ হয়েছে ১৭,৪৫০ হেক্টর, এছাড়া কার্ডিনাল ৮,৭৫০ হেঃ, গ্রানূলা ৬,৬৫০ হেঃ, ডায়মন্ট ৪,৩২৫ হেঃ । স্থানীয় জাতের মধ্যে ফাটা পাকড়ী ৩,০৪০ হে, লাল পাকড়ী ২১০৫ হেঃ, রোমানা পাকড়ী ৮১০ হেঃ। এছাড়া এলভিড়া, ক্যারেজ, মিউজিক, লেডি রোজো, তেল পাকড়ী, সাদা পাকড়ী, পাহাড়ী পাকড়ী, হাগড়াইসহ নানা জাতের আলু চাষ হয়েছে বগুড়ায়।

যাযাদি/ এম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে