শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আয়কর কি শিক্ষার্থীদের ঘাড়েই চাপবে!

যাযাদি ডেস্ক
  ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৪৪
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে একটি আপিল নিষ্পত্তি করে দেয়া রায়ে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। তবে শিক্ষার্থীদের ওপর এই করের বোঝা বর্তাবে না বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

কিন্তু, কখনোই কর না দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কর বাবদ নতুন যোগ হওয়া এই খরচ মেটানোর প্রভাব ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের ওপর কেমন হবে, তা নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ আছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন অবশ্য জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি-সহ অন্যান্য আয় থেকে সমস্ত পরিচালন ব্যয়, বেতন ইত্যাদি মেটানোর পর যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকবে তার ওপর এই কর ধার্য হবে।

তবে শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা, তাদের ওপর খরচের বোঝা বাড়িয়েই এই করের অঙ্ক সমন্বয় করা হবে।

যদিও অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, ‘শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তারা জানবেনও না, কারণ তারা যে বেতন দিয়েছেন তা থেকে সামান্যও বাড়বে না।’

কিন্তু শিক্ষার্থীরা এতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না।

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের শিক্ষার্থী ফয়সাল মাহমুদ বলেন, “এই শঙ্কা তৈরি হয় যে এরপর হিডেন চার্জে দিকে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় একেক রকম ফি নেয়, এটা সামনের দিনে আরো প্রকট হবে।’

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাঞ্জিমুর রহমান রাফির মন্তব্য, ‘কর্তৃপক্ষ আসলে এই কর নিজেরা দেবে না। আগেও যে কোনো ধরনের খরচ ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।’

এই খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন সরাসরিই জানালেন, শিক্ষার্থীদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই এর চাপ পড়বে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের ওপর কর বসানোর সুযোগ থাকা উচিত নয় বলেই মনে করেন তিনি।

আপিল বিভাগের রায়ের পর সভাও করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা। রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এটি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

কবির হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর এই ব্যয় চাপানো যাবে না বলা হলেও, যারা শিক্ষার খরচ নেয়, সেটা তো বাড়ায়ে দেবে তারা। শিক্ষার্থীর ওপরে অটোমেটিক্যালি যাবে। আগে ১০ টাকা নিতো, এখন ১২ টাকা নেবে।’

উচ্চশিক্ষার খরচ আরো বাড়বে? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার খরচ নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা আছে আগে থেকেই। কর-সংক্রান্ত রায়ের ফলে সেই খরচের সূচক আরো বাড়বে বলেই শিক্ষার্থীদের ধারণা।

একই রকম মত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের।

তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের ওপর চাপটা বাড়বে। যেখানে সরকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তদারকি করতেই হিমশিম খায় সেখানে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে তদারকি করা সহজ কাজ নয়। যেসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর-খাজনা দেয়া উচিত কিন্তু যথাযথভাবে দেয় না তাদের ওপর নজরদারি বাড়ালে আয় বাড়ানোর জন্য এসব খাতে সরকারকে নজর দিতে হতো না।

তবে, এই কর আরোপের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেও কাজে লাগানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘যদি প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্বৃত্ত অর্থটাকে পুনর্বিনিয়োগ করতে পারে এবং শিক্ষাখাতে অবকাঠামো, গবেষণা, বৃত্তি, ল্যাব, লাইব্রেরিতে ব্যয় করে তাহলে মুনাফার পরিমাণ ও করের হারটা কমে যাবে। অন্য দিকে তাতে শিক্ষারও মানোন্নয়ন ঘটবে।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ এর আওতাধীন। এই আইনে ট্রাস্টের অধীনে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই সেগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে।

এদিকে বিদ্যমান ট্রাস্ট আইন-১৮৮২ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করযোগ্য নয়।

এখন করের আওতায় আনার ফলে শিক্ষাখাত ব্যবসা খাতভুক্ত হয়ে যায় বলে মনে করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘সামাজিক কল্যাণমূলক খাতকেও আমরা ব্যবসায়িক খাতে পরিণত করছি।’

এই ‘পরিণত করার প্রচেষ্টা’র কারণ হিসেবে তিনি বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ ও বিদেশী ঋণের চাপে অর্থের সঙ্কটকে অন্যতম বলে মনে করেন অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন।

তার কথায়, ‘সামাজিক কল্যাণমূলক খাত থেকে অর্থ উপার্জনের নতুন নতুন খাত যাতে তৈরি না হয় সে জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লুটপাট বন্ধ করা।’

শিক্ষার্থীদের ওপর এই বোঝা চাপবে না সেটা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াটা কী হবে, এমন প্রশ্নও রাখেন এই অধ্যাপক।

বাংলাদেশে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি নির্ধারণে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

২০১০ সালের আইনে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ক্ষমতা ও দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করা আছে, ‘সিন্ডিকেটের সুপারিশক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়-সংবিধির বিধান এবং এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ সৃষ্টি, সৃষ্ট পদের দায়িত্ব-কর্তব্য, চাকরির শর্তাবলী ও বেতনক্রম, শিক্ষার্থী ফি নির্ধারণ এবং নিয়োগ-সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন।’

অর্থাৎ সিন্ডিকেট ও ট্রাস্টি বোর্ডের ওপরই শিক্ষার্থী ফি-সহ অন্যান্য খরচ নির্ভর করে।

মঞ্জুরি কমিশনের অতিরিক্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘আর্থিক সিদ্ধান্ত সমূহের বেশিভাগের ক্ষেত্রেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবারিত স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে।’

গবেষণা-সংক্রান্ত অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে ইউজিসির মতামত দেয়ার বিধান আছে আইনে।

এদিকে, শিক্ষার্থীদের কারো কারো অভিযোগ কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন ফি বা অন্য নামে বাড়তি টাকা এমনিতেই নেয়া হয়। এবার সেটা আরো বাড়বে।

ফলে, বেনামে করের অর্থ আদায় করা হলে তা তদারকি করার উপায় থাকবে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

পক্ষে-বিপক্ষে আইনি লড়াই বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০০৭ সালে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল।

প্রজ্ঞাপনের ভাষ্য ছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয় যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাদের উদ্ভূত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পুনর্নির্ধারণ করা হলো।’

এনবিআর আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০১০ সালের ১ জুলাই।

তাতে বলা হয়, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের উদ্ভূত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়করের হার হ্রাস করে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।’

এই প্রজ্ঞাপন দুটিকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে প্রায় অর্ধশত রিট করা হয়। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ওই রিটগুলো করা হয়েছিল।

২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট প্রজ্ঞাপনগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল বা আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। সেই সাথে, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আয়কর আদায় না করতে এনবিআরকে নির্দেশ দেয়া হয়।

সেই আপিলের শুনানি শেষেই কর দিতে হবে মর্মে রায় ঘোষণা করা হলো।

ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলন সরকার এর আগে ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর সাড়ে সাত শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করেছিল। এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। টানা কয়েক দিন আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

সেই ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মিঠু মোহাম্মদ বলেন, ‘প্রয়োজনীয় খরচ করার পর কোনো বাড়তি অর্থ যদি থাকে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কাজে সেটা ব্যয় করার কথা। আরো বিভিন্ন ধরনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও কাজে নিয়োজিত করার কথা। ট্যাক্স হোক আর ভ্যাট হোক, সরকারিভাবে যখন টাকা নেয়া শুরু হয় তখন আর সেটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান থাকে কিনা সেটাই প্রশ্ন।

সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লাগামটাই এখনো ঠিকমতো ধরতে পারেনি’ মন্তব্য করে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে করের টাকা কর্তৃপক্ষ তার নিজের আয় থেকেই দেবে, এটা নিশ্চিত করা কখনো সম্ভব না।’ সূত্র : বিবিসি

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে