মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
ধান গাছের উচ্চতা কমায় বৈশাখী ঝড়ে ক্ষতি কম

হাবিপ্রবির গবেষণায় উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন

হাবিপ্রবি প্রতিনিধি
  ৩১ মে ২০২৫, ১০:১৬
হাবিপ্রবির গবেষণায় উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন
হাবিপ্রবি’র কৃষি রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ড. বিকাশ চন্দ্র সরকার। ছবি: যায়যায়দিন

প্রতি বছর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে কালবৈশাখী ঝড় ও ভারি বৃষ্টিপাতে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শীষ ভর্তি ধানগাছ হেলে পড়ে ধান ঝরে যাওয়া এবং অধিকাংশ ধান চিটায় পরিণত হওয়ায় কৃষকরা আশানুরূপ ফলন পান না।

এই দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে আশার আলো দেখাচ্ছেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) কৃষি রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ড. বিকাশ চন্দ্র সরকার। তার গবেষণা বোরো ধানের হেলে পড়া কমাতে ও ফলন বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

1

হাবিপ্রবির ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণায় কৃষি রসায়ন বিভাগের পিএইচডি ও মাস্টার্স অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা কাজ করছেন।

প্রফেসর ড. বিকাশ চন্দ্র সরকার জানান, "ঝড়-বাতাসে ধান গাছ হেলে পড়ার কারণে প্রচুর পরিমাণ ধান নষ্ট হয়, কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আমি এই সমস্যা সমাধানে ধান গাছের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য 'গ্রোথ রিটার্ড' ব্যবহার করেছি।"

তার গবেষণা থেকে দেখা গেছে, গ্রোথ রিটার্ড প্রয়োগের ফলে ধান গাছগুলো খাটো হচ্ছে। এর ফলে গাছ হেলে পড়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, খাটো হওয়ার কারণে গাছের চার পাশে অত্যাধিক 'কুশি' বা নতুন চারা গজাচ্ছে। সাধারণত একটি ধান গাছে ১০-১৫টি কুশি গজালেও, এই পদ্ধতিতে ৪০-৫০টি পর্যন্ত কুশি আসছে এবং প্রতিটি কুশিতেই ধানের শীষ বের হচ্ছে।

ড. সরকার কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করে বলেন, "ধান গাছ লম্বা হলে বাতাস বা বৃষ্টিতে হেলে পড়ে, গ্রেইনগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং চূড়ান্ত উৎপাদন কমে যায়। কিন্তু আমাদের এই পদ্ধতিতে গাছ খাটো থাকার কারণে বাতাসে হেলে পড়ে না, গ্রেইন নষ্ট হয় না এবং উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।"

গ্রোথ রিটার্ড প্রয়োগের মাত্রা নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ড. সরকার বলেন, "আমার গবেষণা থেকে দেখেছি, গ্রোথ রিটার্ডের যত ডোজ আমি দিচ্ছি, ততই গাছগুলো ছোট হচ্ছে। তবে আমরা বেশি ছোটতে যাব না, কারণ এতে ধানের গ্রেইন কমে যায়। কুশিগুলোতে শীষ এলেও শীষে গ্রেইনের সংখ্যা কমে যেতে পারে।"

তিনি আরও জানান, গবেষকরা এমন একটি সর্বোত্তম মাত্রা খুঁজে বের করেছেন যেখানে কুশির সংখ্যা, শীষের সংখ্যা এবং প্রতিটি শীষে গ্রেইনের সংখ্যা সর্বোচ্চ থাকে, পাশাপাশি গাছের উচ্চতাও যথেষ্ট ছোট থাকে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, উঁচু গাছের তুলনায় খাটো গাছে পোকার উপদ্রব অনেক কম দেখা যাচ্ছে।

এই গবেষণার ফলাফল কৃষকদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে করেন ড. সরকার। তিনি বলেন, "লম্বা গাছ হেলে পড়লে ধান ঝরে যায়, শীষ পানিতে ডুবে গিয়ে চিটায় পরিণত হয় এবং উৎপাদন কমে যায়। আমাদের গবেষণা অনুযায়ী, এই পদ্ধতি প্রয়োগে বিঘা প্রতি সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ বাড়তে পারে।

কিন্তু খরচের তুলনায় কৃষকের লাভ অনেক বেশি হবে, কারণ ধান গাছ হেলে না পড়ায় ধান নষ্ট হবে কম, সাথে অতিরিক্ত কুশি ও অতিরিক্ত ধান পাওয়া যাবে। এতে কৃষকরা উল্লেখযোগ্যভাবে অধিক ফলন পাবেন।"

প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "গ্রোথ রিটার্ড চারা অবস্থায় প্রয়োগ করা হয়, তখন থেকেই গাছ খাটো হতে শুরু করে। এর ২০ দিন পর আবার প্রয়োগ করলে গাছের উচ্চতা আরও কমে যায় এবং নতুন নতুন কুশি গজাতে শুরু করে।"

তিনি আরো বলেন, "গাছের উচ্চতা বৃদ্ধিতে যে বায়োমাস কাজে লাগতো, সেটা এখন কুশি গজাতে কাজে লাগছে। তবে, বেশি কুশি জন্মানোর ফলে গাছে সারের চাহিদাও বেড়ে যাবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে সার প্রয়োগ করলে প্রত্যেক কুশি থেকে সুস্থ শীষ পাওয়া যাবে। অর্থাৎ, বেশি ধান পেতে গেলে খাদ্যের (সারের) পরিমাণও বেশি দিতে হবে।"

এই গবেষণাটি দেশের বোরো ধান চাষে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে এবং কৃষকদের দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তা লাঘবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে