রোববার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নানা সংকটে ধুঁকছে চট্টগ্রামের চামড়াশিল্প

মনির ফয়সাল, চট্টগ্রাম
  ২৫ মে ২০২৫, ১৭:২৯
আপডেট  : ২৫ মে ২০২৫, ১৭:৪০
নানা সংকটে ধুঁকছে চট্টগ্রামের চামড়াশিল্প
ছবি: সংগৃহীত

দেশের চামড়া শিল্পে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে চলেছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। প্রতি বছর শুধুমাত্র কোরবানি ঈদে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ পশুর চামড়ার যোগান দেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বছর ঘুরলেও চামড়া ব্যবসায়ীদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না। একে একে ট্যানারি শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসা হয়ে যায় ঢাকা নির্ভর। এরপর নানা সংকটে ধুঁকছে এখানকার চামড়াখাত।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ঢাকার ট্যানারি মালিক সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। তাদের মর্জিমাফিক দরে চামড়া বিক্রি করতে হয়। আর পাওনা টাকা পেতে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর।

1

জানা যায়, চট্টগ্রামে ট্যানারি না থাকায় তারা জিম্মি ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে। মৌসুমি ও ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রথমে চামড়া সংগ্রহ, পরে লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকায় পাঠানোসহ সবই করেন আড়ৎদাররা। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিভিন্ন সময় টাকা আটকে পড়া, বহু দেনদরবার করেও সেই টাকা আদায় করতে না পারায় গত কয়েক বছরে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন চট্টগ্রামের অন্তত দুইশ’ আড়ৎদার। প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছেন মাত্র ২৫-৩০ জন। এখন তাদের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছে।

দেউলিয়া হয়ে পড়া এক ব্যবসায়ী হলেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর মো. সামশুল আলম। বাবা আহমদ হোসেন ৪৯ বছর ধরে এ ব্যবসা করেছিলেন। ২০২০ সালে মারা যান তার বাবা। সামশুল আলম বলেন, ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকার বকেয়া পাচ্ছেন না আট বছর ধরে। এছাড়া ২০২২ সালে ৩৮ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। সবমিলে ধার-দেনা ও ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে আর দাঁড়াতে পারেননি। পুঁজি হারিয়ে তার মতো অন্তত দুই শতাধিক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে নগরের আতুড়ার ডিপু এলাকার একজন প্রসিদ্ধ কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, ‘চট্টগ্রামে মাত্র একটি ট্যানারি থাকায় আমাদের বেশির ভাগ চামড়া ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে হয়। এতে তারা প্রতিবছর আমাদের কোটি কোটি টাকা আটকে রাখে।’

ওই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, গত এক দশকের ব্যবসায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে ৩০ কোটি টাকা পাবেন। তাঁরা এই টাকা পরিশোধে সব সময় গড়িমসি করেন।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার-ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল কাদের বলেন, টাকা সংকটে ধুঁকছেন আড়ৎদার ও ব্যবসায়ীরা। গত বছরের বকেয়া টাকা এখনো পাওয়া যায়নি। এর আগেরও প্রায় ২৫ কোটি টাকা বকেয়া পাওনার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিবছর কোরবানি আসলে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর বৈঠক করে। আমরা সংকটের কথা বলে আসছি। কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। চট্টগ্রামে আরও দু-একটি ট্যানারি থাকলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পেতেন বলে জানান তিনি।

জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, কানাডা, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জাপান, চীন, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, রাশিয়া, পোল্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করা হয়। তবে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ইতালিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে দেশটিতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে চামড়া খাতে রপ্তানিও কমে গেছে।

সূত্র জানায়, পাকিস্তানের বহু ব্যবসায়ী শিল্পপতি চট্টগ্রামে ট্যানারি শিল্প গড়ে তুলেছিলেন। মূলত সস্তা শ্রম, প্রচুর কাঁচামাল এবং বন্দর সুবিধাসহ নানা সুবিধা কাজে লাগিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করতেন। তখন পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের হাতে ট্যানারি শিল্পের প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণই ছিল। ট্যানারি শিল্পের স্বর্ণযুগে চট্টগ্রামে বাংলাদেশি মালিকানাধীন মন্টি ট্যানারি নামের একটি মাত্র ট্যানারি ছিল। বাকি সব ট্যানারি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। স্বাধীনতার পর কারখানাগুলো সরকারের হাতে চলে যায়। সরকারি খাতে কিছুদিন চালানোর পর দেশের ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে নেন। পুরোনো ট্যানারিগুলোর পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন ট্যানারিও ওই সময় গড়ে ওঠে। হিলটন লেদার নামের ট্যানারি ছিল ওই সময়কার দেশের প্রথম অত্যাধুনিক ট্যানারি।

এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে ওরিয়েন্ট ট্যানারি, মেঘনা ট্যানারি, জামান রহমান ট্যানারি, জুবিলি ট্যানারি, সিকো লেদার, চিটাগং লেদার, কর্ণফুলী লেদার, মদিনা ট্যানারি, মেট্রোপলিটন লেদার, রিফ লেদারসহ ২২টি ট্যানারি গড়ে ওঠে। বেশ জমজমাট ব্যবসা চলে ট্যানারি শিল্পের। চট্টগ্রাম থেকে কোটি কোটি টাকার চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু একপর্যায়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। একে একে বন্ধ হতে থাকে ট্যানারি। শুরুতে মেট্রোপলিটন লেদার চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায় চলে যায়। বাকিগুলোর মধ্যে শুধু রিফ লেদার চট্টগ্রামে থাকলেও বাকিগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে অনেকগুলোর অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, ১৯৯১ সালের পর এই শিল্পে চট্টগ্রামে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে উঠা রিফ লেদারই এই শিল্পের চট্টগ্রামে শেষ বিনিয়োগ। রিফ লেদার এখনো ব্যবসা করছে বলে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, তারা চট্টগ্রামে চামড়া শিল্পের কাঁচামালের যে যোগান তার খুব সামান্য অংশই ব্যবহার করতে পারে। শুধুমাত্র কোরবানিতে চট্টগ্রামে প্রায় আট লাখের মতো গরু মহিষ ও ছাগলের চামড়া পাওয়া যায়। এর বাইরে বছর জুড়ে চট্টগ্রামে পাওয়া চামড়ার সংখ্যা বিশ লাখেরও বেশি। কঙবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই সংখ্যা বছরে প্রায় অর্ধ কোটি। এসব চামড়া দিয়ে চট্টগ্রামে অনায়াসে চল্লিশটি কারখানা চলতে পারে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, অথচ চট্টগ্রামে একটি কারখানা চলছে। যা পুরো বছরে লাখ খানেক চামড়া ব্যবহার করতে পারে।

রিফ লেদারের পরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামে বিভিন্ন খাতে বড় বড় শিল্প গ্রুপের বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু চামড়াশিল্পে না থাকাটা দুঃখজনক।

পরিবেশগত সমস্যার কারণে এ শিল্প নিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের নামকরা ব্র্যান্ড ও চামড়াজাত পণ্য কোম্পানিগুলো এখন কিছুটা পরিবর্তন আনছে। ৮০ শতাংশ সিনথেটিকের সঙ্গে ২০ শতাংশ চামড়া ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে দেশীয় বাজারেও চামড়ার ব্যবহার বাড়ানো গেলে চামড়াশিল্পের সুদিন ফিরবে বলে আশা করছি।’

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় কিনি। লবণ দেওয়ার পর ট্যানারি মালিকরা যখন আমাদের কাছ থেকে চামড়া নিতে আসেন, তখন তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অনেক চামড়া বাদ দিয়ে দেন।’

চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়ার শীর্ষস্থানীয় এই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, ‘গুদাম ভাড়া, শ্রমিকের বেতন ও লবণ দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা সব কিছুই আমাদের নগদ টাকায় করতে হয়। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা বাকিতে চামড়া নিয়ে যান।’

আড়ৎদাররা পাওনা টাকা না পাওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিটিএ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এটি একটি প্রচলিত নিয়ম, সারা বছরই আড়ৎদারদের সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যবসা করা হয়। শুধু অভিযোগ আসে কোরবানির সময়। ব্যবসায় লেনদেন থাকবেই। সব টাকা পুরোপুরি পরিশোধ করে কেউ ব্যবসা করে না। কারণ সবারই টানাপড়েন থাকে। তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে চামড়াশিল্পের অবস্থা ভালো নয়। অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ট্যানারিও এখন বন্ধ হওয়ার পথে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে