বাংলাদেশের জীবন ঘনিষ্ঠ অভিনয় শিল্পের পরিচয় দিতে গেলে যে নামটি শুরুতেই এসে যাবে তিনি নাট্যকার মামুনুর রশীদ। একাধারে অভিনেতা, নাট্য নির্দেশক এবং নাট্যকার। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চ আন্দোলনের পথিকৃৎ। পাশাপাশি সংগঠক হিসেবেও পরিচিত তিনি। ছিলেন ’৭১ এর রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালীন তার প্রথম রচিত নাটক ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’ কলকাতার রবীন্দ্র সদনে মঞ্চায়নের চেষ্টা করেন; কিন্তু তার আগেই ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে নাটকটি সেখানে আর অভিনীত হয়নি। পরে নাটকটি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে অভিনীত হয়। ১৯৭২ সালেই কলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আরণ্যক নাট্যদল’।
মামুনুর রশীদ এমন অভিনেতা যিনি অভিনয়কে নিছকই বিনোদনের খোরাক হিসেবে নেননি। এ কারণেই তার নাট্যকর্মে অত্যন্ত প্রখর সমাজ সচেতনতা লক্ষ করা যায়। শ্রেণি সংগ্রাম তার নাটকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। তবে তিনি অনেক কমেডি নাটকও লিখেছেন। সর্বশেষ এই কমেডি ঘরানার মঞ্চ নাটক ‘কহে ফেসবুক’ তার অন্যতম নিদর্শন।
নাট্যাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় মামুনুর রশীদ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ নাট্যকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেও স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেন। শিল্প-সংস্কৃতির শুদ্ধতা বিষয়ে আপসহীন এই অভিনেতা নাট্যকলার মধ্য দিয়ে কোনো না কোনো ম্যাসেজ বা বার্তা পৌঁছে দেন জাতিকে।
টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতির পাইকড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া মামুনুর রশীদ বহু নাটকে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে নিজ অঞ্চলের কথ্যবুলিকেও পৌঁছে দিয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। জনপ্রিয় করেছেন নিজ অঞ্চলের ভাষাকে। সেদিক থেকে আজকে যারা আঞ্চলিক ভাষাকে জনপ্রিয় করতে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন তাদের সবারই পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন এই অভিনেতা। ছোটপর্দার পাশাপাশি ২৫টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। যার সবই শ্রেণি-সংগ্রামের ওপর হওয়া জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা।
মারধর ও অ্যাকশন ধর্মী কোনো বাণিজ্যিক সিনেমায় অভিনয় করেননি তিনি। গাজী রাকায়েত হোসেন পরিচালিত ‘মৃত্তিকা মায়া’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ২০১৩ সালে তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সর্বশেষ ২০২৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা হৃদি হকের ‘১৯৭১ সেইসব দিন’। চলচ্চিত্রে মামুনুর রশীদ যেসব সিনেমায় অভিনয় করেছেন শ্রেণি-সংগ্রাম ঘনিষ্ঠ হিসেবে সবই উল্লেখযোগ্য। ‘মনপুরা’, ‘অলাতচক্র’, ‘ভূবন মাঝি’, ‘মেয়েটি এখন কোথায় যাবে’, ‘শঙ্খচিল’, ‘আধিয়ার’, ‘কিত্তনখোলা’ ‘হরিজন’ এবং ‘ফিরে এসো বেহুলা’ প্রভৃতি তার অন্যতম চলচ্চিত্র।
মঞ্চনাটকে মামুনুর রশীদের যেসব কাজ সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছে সেগুলো- ‘ওরা কদম আলী’, ‘ইবলিশ’, ‘গিনিপিগ’, ‘বঙ্গভঙ্গ’, ‘রাষ্ট্র বনাম’ এবং ‘গন্ধর্ব নগরী’ প্রভৃতি। বরেণ্য নাট্যকার মামুনুর রশীদ ধারাবাহিক নাটকও পরিচালনা করেছেন। ‘অলসপুর’ তার উল্লেখযোগ্য কীর্তি।
অভিনেতা মামুনুর রশীদ রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে যেমন বিশ্বাস করেন তেমনই প্রভাব দেখা যায় তার অভিনয় এবং নাটক রচনায়। নাটক ছাড়া যেসব চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সেগুলোতেও। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে এমন আদর্শবাদী অভিনয় শিল্পী বলতে গেলে একদমই নগণ্য, নেই বললেই চলে। অভিনেতা মামুনুর রশীদের ভাষায় তার আদর্শবাদিতার মূল সুরই দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেমই প্রতিফলিত হয়েছে তার প্রতিটি মঞ্চ নাটকে, টিভি নাটকে, বেতার বা চলচ্চিত্রের অভিনয়ে। যে কারণে যথেষ্ট অভিনয় ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে যেমন খুব বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়নি তেমনি টিভি নাটকেও অভিনয় করেছেন বেশ হিসাব-নিকাশ করে। অভিনয় করতে গিয়ে অন্যদের মতো দেশপ্রেম বিবর্জিত একেবারে যত্রতত্র গা ভাসিয়ে দেননি। মূলত এই দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ’৭১ এর রণাঙ্গনে মামুনুর রশীদ। এ নিয়ে তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, যে যুদ্ধটা ছিল একেবারেই অসম আবার নিরস্ত্রও প্রায়- এমন প্রেক্ষাপটে কী সাহসে সেই যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিলেন- এর পটভূমিকাটাই কী?
তখন তিনি এক নাগারে বলে চললেন, ‘এটা এক কথায় দেশপ্রেম। একেবারে নির্ভেজাল দেশপ্রেম। পটভূমিটা তৈরি হয়েছিল ষাটের দশকে, যদি বলি তারও অনেক আগে। সেই ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, তারও আগে ১৯৪৮ সাল- যেখান থেকে এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল। যেখান থেকে একটা দেশপ্রেম তৈরি হয়েছিল, তারপরে তাদের নৃসংশতাই পরবর্তীকালে ঠেলে দেয় আমাদের প্রতিরোধে যেতে- একটা প্রতিরোধের স্পৃহা তৈরি হয়েছিল। সে অবস্থায় আমরা নিরস্ত্র হলেও অস্ত্র সংগ্রহ করতে কোনো অসুবিধা তৈরি হয়নি আমাদের। কারণ সেরকম পরিস্থিতিতে অস্ত্র সংগ্রহ করাও তেমন ব্যাপার নয়। এখানে দেশ প্রেমটাই ছিল প্রধান নিয়ামক। যে কারণে বহির্বিশ্বে যেসব দেশ আমাদের সমর্থক ছিল সেসব দেশ থেকেই বিভিন্ন ওয়েতে অস্ত্র আসতে থাকল। তবে ওই যুদ্ধে অস্ত্রের চাইতে আমাদের দেশপ্রেমের শক্তিটাই ছিল প্রধান।’
সেক্ষেত্রে কারও ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে সংশয় না থাকলেও মানুষের মধ্যে তো একটা আদর্শগত ভিন্নতা থাকেই- সেক্ষেত্রে অভিনেতা মামুনুর রশীদদের আদর্শ কী ছিল এমন প্রশ্নে তিনি বলেন- ‘হ্যাঁ, ওই যুদ্ধে দেশ প্রেমটাই প্রধান নিয়ামক হলেও এটাও ঠিক যে, সেখানে মতাদর্শগতও বহুতা ছিল। আমাদেরও একটা ভিন্ন আদর্শ ছিল। আমি এখনো বিশ্বাস করি এবং তখনো বিশ্বাস করতাম মানুষের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। কাজেই জাতীয় সংগ্রামের পরে সেটা পরবর্তী সময়ে শ্রেণি সংগ্রামে মোড় নেবে এমন একটা প্রত্যাশা তো ছিলই। সেটা হয়নি বলেই ১৯৭১ এ জাতীয় সংগ্রাম যেখানে এক পাটাতনে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর শ্রেণি সংগ্রাম এক পাটাতনে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।’
যাযাদি/ এস