শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ম বছরে ৪ ফসলের সম্ভাবনা ম আউশের নতুন জাত ব্রি-৯৮ ম বিঘায় ফলন ২৩ মণ ধান

দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময়ে ভালো ফলনে খুশি কৃষকরা

আউশ মৌসুমের প্রচলিত জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান-৪৮ এর ফলন পাওয়া যাচ্ছে বিঘা প্রতি সর্বোচ্চ ১৪ থেকে ১৫ মণ। গত বছর উপজেলার তিনটি গ্রামে মাত্র ২ হেক্টর জমিতে ব্রি ধান-৯৮ এর পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করা হয়। ব্রি ধান-৯৮ সবচেষে বেশি চাষ হয়েছে বগুড়ায়। গ্রামের কৃষক আয়াত আলী. তমিজ উদ্দিন ও মানিক মিয়া প্রথমবারের মতো চাষ করেছেন ব্রি ধান-৯৮ জাতটি। প্রচলিত সব জাতের থেকে ফলনের বেশি ও আকার আকৃতিতে চিকন হওয়ায় বেশ খুশি তারা। ধান চিকন হওয়ায় দামেও সুবিধা পাওয়া যাবে বলে জানান তারা। ব্রি ধান-৪৮ এর চেয়ে অন্তত মণ প্রতি ধানের মান ভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি পাওয়া যাবে।
ইমরান ছিদ্দিকি
  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

উন্নত জাতের অভাব এবং খরা, বন্যা ও অতিবৃষ্টির ঝুঁকির কারণে দেশে এখন আউশ ধান অনেক কমে গেছে। বোরো ও আমনের চাষ বেড়েছে। ইতোমধ্যে দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা স্বল্পজীবনকালীন উন্নত জাতের আউশ ধান উদ্ভাবন করেছেন। ব্রি ৯৮ মাঠে খুবই সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। এ জাতটি মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয় করতে পারলে দেশে আউশ আবার বড় ফসলে পরিণত হবে। একইসঙ্গে, এটি লাভজনক ফসল হিসেবে কৃষকের মুখে হাসি নিয়ে আসবে।

বাংলাদেশে তিন মৌসুমে ধানের চাষ করা হয়- আউশ, আমন ও বোরো মৌসুম। বোরো ধান চাষে প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহৃত হয়। এতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর দিনের পর দিন নিচে নামছে- যা কাঙ্ক্ষিত নয়। যেহেতু আউশ ধানের আবাদ বৃষ্টি নির্ভর, সেহেতু এ ধান উৎপাদনে সেচ খরচ সাশ্রয় হয়। ফলে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রচলিত শস্য পর্যায় পরিবর্তন করে আউশ ধান অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। তাছাড়া বর্তমানে অবমুক্তকৃত উচ্চফলনশীল জাতের চাষ করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। আগস্ট মাসে আউশের একটি নতুন জাত মাঠপর্যায়ে চাষ করে বিঘায় ২৩ মণ পরিমাণে ধান পেয়েছেন কৃষকরা। এমন স্বপ্নের ধানের অপেক্ষায় ছিলেন কৃকরা। দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময়ে ভালো ফলন পেয়ে কৃষকরা অনেক খুশি।

নতুন জাতের ধানের বাম্পার ফলন, বছরে ৪ ফসলের সম্ভাবনা দেখছে সরকার। নতুন জাতের এই ধান ৯০ থেকে ১০০ দিনে উৎপাদন হচ্ছে। সাধারণত ১৪০ থেকে ১৬০ দিনের মধ্যে ধান উৎপাদন হয়। তবে সেই ধান যদি ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে ঘরে তোলা যায়, সেটি বিরাট সম্ভাবনাময়। আর 'ব্রি-৯৮' আউশ ধান সেই সম্ভাবনাই নিয়ে এসেছে। ফলনও বিঘাতে ২৫ থেকে ৩০ মণ। এ জাতটি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

আউশ ধান দুইভাবে চাষ করা হয়। বোনা আউশ এবং রোপা আউশ। ব্রি ধান-৯৮ জাতের এক হাজারটি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ২২.৬ গ্রাম। ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৭.৯ ভাগ এবং প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৯.৫ ভাগ। ভাত ঝরঝরে। আউশ মৌসুমের জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান ৪৮ অপেক্ষা ফলন বেশি এবং রোগবালাই ও পোকামাকড় কম। এদিকে দিন দিন কৃষি জমি কমে যাচ্ছে, বিপরীতে জনসংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান ঠিক রাখতে হলে একই জমি থেকে বছরে বারবার ফসল ফলাতে হবে, বেশি করে ফসল ফলাতে হবে।

একই জমিতে বছরে চারটি ফসল ঘরে তোলার পরিকল্পনার কথা জানান কৃষক হালিম। তিনি জানান, ব্রি-৯৮ জাতের এই আউশ ধানটি ২০ দিনের চারাসহ মোট ৯৮-১০০ দিনের মধ্যে কর্তন করেছেন। এর আগে তিনি এই জমিতে বোরো মৌসুমে ব্রি ৯৬ চাষ করেছিলেন। এখন তিনি আমনের ব্রি ৭৫ লাগাবেন এবং আমন কেটে স্বল্প জীবনকালীন সরিষার আবাদ করবেন। মানিকগঞ্জে রোপা আউশ মৌসমে ব্রি ধান-৯৮ এর ফলন দেখে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। কৃষকরা মাঠে আনন্দে গান গেয়ে ধান কাটেন। মাঠে মাঠে রোদের উজ্জ্বল হাসি, বাতাসে দুলছে পাকা সোনালি ফসল।

নেত্রকোনার কাশিগঞ্জের কৃষক হারেজ আলী বলেন, আনন্দ লাগছে সোনালি ধান দেখে। এ সময় জমিতে এত ধান হবে ভাবতে পারিনি। গত বছরগুলোতে আউশ মৌসুমে যে পরিমাণ জমিতে সর্বোচ্চ ভালো হলে ৫ মণ ধান পেতাম। আর এ বছর সেখানে ব্রি ধান-৯৮ রোপণ করে ২২ মণ ধান পাবো বলে আশা করছি। সেই কারণে মনে এত আনন্দ।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক কৃষক হাসেম আলী বলেন, আমি অনেকের কাছে এই ধানের কথা শুনেছি। তাই দেখতে এসেছি। ব্রি ধান-৯৮ জাতটা খুব ভালো। এই জাতের প্রতিটি ক্ষেতে ভালো ধান হয়েছে। চিটা নেই বললেই চলে। প্রতিটি ক্ষেতের ধান গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথায় বড় বড় ধানের ছড়া নিয়ে। সোনালি ফসল বাতাসে দোল খাচ্ছে। দেখে খুব ভালো লাগল। আমিও আগামী বছর আউশ মৌসুমে আমার ৬ বিঘা জমিতে এই ধান রোপণ করব।

রাজবাড়ী সদর উপজেলায় কৃষক আমানত আলী জমিতে কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ধান, গম ও পাট বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের আওতায় ব্রি ধান ৯৮ ধানের চাষ করা হয়। ব্রি ধান ৯৮ আউশ মৌসুমের ধানের জাত। জীবনকাল ১১২ দিন এবং এর ফলন প্রতি বিঘায় ২২ মণ। এর দানা লম্বা ও চিকন। আউশ মৌসুমের জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান-৪৮ অপেক্ষা ফলন বেশি এবং রোগবালাই ও পোকামাকড় কম।

ময়মনসিংহের ফুলপুরে আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে আউশ মৌসুমের নতুন জাত ব্রি ধান-৯৮ কাটা শেষ করেছেন কৃষকরা। বিঘা প্রতি ফলন পেয়েছেন ১৮ থেকে ২০ মণ। চলতি বছর এ ধানের বাম্পার ফলনে খুশি কৃষকরা। কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে ব্রি ধান-৯৮ জাতের চারা রোপণ করেন চাষিরা। অথচ গত কয়েক মাস আগেও কৃষকরা এ জাতের ধান সম্পর্কে জানতেন না। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা আউশ মৌসুম শুরুর পূর্বে কৃষকদের ব্রি ধান-৯৮ চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। পরে বিএডিসি বীজ ডিলারদের মাধ্যমে বিভিন্ন বাজারে বীজের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেন। স্থানীয় কৃষি উপ-সহকারীর পরামর্শ ও সহযোগিতায় কৃষকরা ব্রি ধান-৯৮ বীজ কিনে বীজতলা তৈরি করে। মৌসুম শেষে কৃষককের ঘরে ও ওঠানে সোনালি আউশ ধান গড়াগড়ি খাচ্ছে।

আউশ মৌসুমের প্রচলিত জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান-৪৮ এর ফলন পাওয়া যাচ্ছে বিঘা প্রতি সর্বোচ্চ ১৪ থেকে ১৫ মণ। গত বছর উপজেলার তিনটি গ্রামে মাত্র ২ হেক্টর জমিতে ব্রি ধান-৯৮ এর পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করা হয়। ব্রি ধান-৯৮ সবচেষে বেশি চাষ হয়েছে বগুড়ায়। গ্রামের কৃষক আয়াত আলী. তমিজ উদ্দিন ও মানিক মিয়া প্রথমবারের মতো চাষ করেছেন ব্রি ধান-৯৮ জাতটি। প্রচলিত সব জাতের থেকে ফলনের বেশি ও আকার আকৃতিতে চিকন হওয়ায় বেশ খুশি তারা। ধান চিকন হওয়ায় দামেও সুবিধা পাওয়া যাবে বলে জানান তারা। ব্রি ধান-৪৮ এর চেয়ে অন্তত মণ প্রতি ধানের মান ভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি পাওয়া যাবে।

এ বিষয়ে উপ-সহকারী কৃষি অফিসার সজল দাস বলেন, এর আগে ব্রি ধান-৯৮ চাষ হয়নি। মৌসুমের শুরুতে আউশ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জাতটি নিয়ে কাজ শুরু করি আমরা। আউশের জমি বৃদ্ধির সুযোগ নেই, তাই জাত পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনযোগ দিয়েছি। প্রথমদিকে প্রচন্ড খরা আর তাপদাহে কৃষকরা কিছুটা হতাশ ছিলেন, তবে সেচের ব্যবস্থা হতেই ধানের বৃদ্ধিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এখন ফলন দেখে কৃষক বেশ খুশি।

এ বিষয়ে কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সমিরন রায় বলেন, ২০২১ সাল থেকে ব্রি ধান-৯৮ জাতটি সম্পর্কে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। জাত পরিবর্তনের মাধ্যমে আউশের ফলন ও উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ময়মনসিংহের হালুয়াহাট উপজেলায় যোগদানের পরই কাজ শুরু করি। প্রচন্ড তাপদাহ উপেক্ষা করে উপ-সহকারী কৃষি অফিসাররা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন। নতুন করে ২৩৭ হেক্টর জমি আউশের আওতায় এসেছে। তবে শুধু জাত পরিবর্তন বিবেচনায় নিয়ে ব্রি ধান-৪৮ এর তুলনায় বিঘা প্রতি ৩ মণ অতিরিক্ত ফলন হিসেবে এ বছর দেবিদ্বার উপজেলায় ব্রি ধান-৯৮ সম্প্র্রসারণের ফলে প্রায় ৯৪১ টন অতিরিক্ত ধান উৎপাদন হবে- যার বাজারমূল্য ১১০০ টাকা মণপ্রতি হিসাবে ২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আগামীতে ব্রি ধান-৯৮ আউশ মৌসুমের মেগা ভ্যারাইটি হয়ে উঠবে। এ জাতের ধানে বিঘা প্রতি ২২ মণ ফলন হয়। কৃষক এই ধান দেখে আগামীতে তাদের জামিতে রোপণের জন্য আগ্রহ করছেন। সে জন্য কৃষক আক্কাস আলী এ বছর এই জাতের সব ধান রেখে দেবেন বীজের জন্য। যাতে আগামী বছর আউশ মৌসুমের সময় এই বীজ কৃষকদের দিতে পারেন। উদ্দেশ্য হলো বিঘা প্রতি ফসল উৎপাদন বাড়ানো।

চারা লাগানোর সময় বা বীজবপনের সময় বৃষ্টিপাত না হলে সময়মতো চারা রোপণ বা বপনের জন্য সম্পূরক সেচ দিতে হবে। সরাসরি বীজবপনের ক্ষেত্রে জমিতে জো অবস্থা বিরাজমান না থাকলে অঙ্কুরিত বীজ জমিতে কাদা করে লাইনে ছিটিয়ে বীজবপন করতে হবে। আউশ মৌসুমে সাধারণত খোলপোড়া রোগ, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগ, টুংরো এবং বাকানি রোগের প্রকোপ দেখা যায়। খোলপোড়া রোগ দমনের জন্য জমির পানি বের করে দিয়ে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। আউশে মাজরা পোকা, পামরি পোকা, থ্রিপস, গান্ধি পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং এবং বাদামি গাছ ফড়িং। পোকা দমনে আলোর ফাঁদ এবং পার্চিং ব্যবহার করতে হবে। ৮০ ভাগ ধান পাকলে ধান কাটতে হবে। তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ধান মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। বাদলা দিনে ধান মাড়াই করে সাধ্যমতো ঝেড়ে বৃষ্টিমুক্ত স্থানে ছড়িয়ে দিয়ে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে