শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

টেকসই উন্নয়ন ও কৃষি

করোনাকালীন দুঃসময়েও দেশের কৃষি এগিয়ে গিয়েছে তার নিজস্ব গতিতে। চাল উৎপাদনে কয়েক বছরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বাংলাদেশ এখন চাল রপ্তানিকারক দেশ। অন্যদিকে, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। দেশে বিগত পাঁচ বছরে ভুট্টার উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে ২৭ লাখ টন হতে ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার সর্বাধিক ফলন ১১ টন। আর বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার ফলন পৌনে ১০ টন- যা বিশ্বে তৃতীয়। প্রতি বছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে
আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
  ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) উলেস্নখ আছে- ক্ষুধা থেকে মুক্তি, খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টির মানোন্নয়ন এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই কর্মপদ্ধতির বিকাশ সাধন। বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে নানাবিধ উপায়ে খাদ্য নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যার সঙ্গে পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ জনসংখ্যায় পৃথিবীতে ৮ম কিন্তু আয়তনের ৯৪তম দেশ। এখানে এক লাখ সাতচলিস্নশ হাজার পাঁচশত সত্তর বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় আঠার কোটি মানুষের বসবাস। সঙ্গে আরো রয়েছে প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীর আশ্রয়। তাই বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি ভূখন্ড থেকে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের সংস্থান করা নিঃসন্দেহে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু গত দেড় দশকে সবাইকে তাক লাগিয়ে সেই অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ। দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় উন্নতি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন। বৈশ্বিক কৃষিতে বাংলাদেশের কৃষির সফলতার গল্প আজ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উদাহরণ।

করোনাকালীন দুঃসময়েও দেশের কৃষি এগিয়ে গিয়েছে তার নিজস্ব গতিতে। চাল উৎপাদনে কয়েক বছরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বাংলাদেশ এখন চাল রপ্তানিকারক দেশ। অন্যদিকে, স্বাধীনতাত্তোর সময়ে বাংলাদেশে ভুট্টা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ গুন। দেশে বিগত পাঁচ বছরে ভুট্টার উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে ২৭ লাখ টন হতে ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার সর্বাধিক ফলন ১১ টন। আর বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার ফলন পৌনে ১০ টন- যা বিশ্বে তৃতীয়। প্রতি বছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে খাদ্যের চাহিদা বছরে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর এ খাদ্যের মূল উপাদান ভুট্টা।

বিশ্বে পরিবেশবান্ধব তন্তু বিবেচনায় পাটের কদর দিন দিন বেড়েই চলছে। আর সে পাট উৎপাদনে পৃথিবীতে ভারতের পরই বাংলাদেশের স্থান। কিন্তু পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বাংলাদেশে চা শিল্পের বাজার ২০ হাজার কোটি টাকার উপরে। বিগত চার দশকে দেশে চা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি'র প্রতিবেদন অনুসারে, চা উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান গত বছর ৯ম স্থানে উন্নীত হয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। পেঁয়াজ ও ফুলকপি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে নবম। আলু উৎপাদনে সপ্তম। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এখন আলু রপ্তানি হচ্ছে। বিশ্বে প্রতি বছর যে হারে শাকসবজি চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতেও বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়। তবে বছরব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন সবজি উৎপাদন, পরিবহণ ও ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ফল উৎপাদনে উষ্ণমন্ডলীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশ দশম আর সামগ্রিকভাবে ২৮তম। কিন্তু ফল উৎপাদনের আওতা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে করছে। বাংলাদেশ কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আম উৎপাদনে ৭ম। পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম। পেঁপে উৎপাদনে ১৪তম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আম-কাঁঠাল রপ্তানি শুরু হয়েছে। ইউরোপের বাজারেও বাংলাদেশের আমের চাহিদা তৈরি হয়েছে।

স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। বিগত কয়েক দশকে মৎস্যক্ষেত্রে বাংলাদেশে নীরব বিপস্নব ঘটেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদিত হয়, তার ৮৬ শতাংশই হয় আমাদের দেশে। ইলিশের প্রজনন, বংশবৃদ্ধি এবং জাটকা সংরক্ষণে বাংলাদেশের মডেল এখন বিশ্বের অনেক দেশই অনুসরণ করছে। এক সময় সাদা সোনা হিসেবে পরিচিত চিংড়ি রপ্তানিতেও বাংলাদেশের সম্ভাবনা ছিল প্রকট।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বাংলাদেশে পালনকৃত গবাদি পশুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি। শুধু তা-ই নয়, গবাদি পশু পালনে সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে। ছাগল উৎপাদনেও বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। আবার ছাগলের মাংসের গুণগত মান ও স্বাদ এবং উৎপাদনশীলতা বিবেচনায় আমাদের নিজস্ব জাত বস্নাক বেঙ্গল গোট বিশ্বখ্যাত। কয়েক বছর আগেও প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ানমার থেকে আমদানিকৃত গরু দিয়েই মিটত দেশের মাংসের চাহিদা। প্রতি বছর কোরবানির সময় দেশ দুটি থেকে আমদানি হতো ২২ থেকে ২৫ লাখ গবাদি পশু। কিন্তু সেই নির্ভরতা কমিয়ে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে বাংলাদেশ।

ধানসহ নানাবিদ ফসলের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বখ্যাত। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। পাশাপাশি বিশেষ পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসলের জাত উন্নয়নে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রতি বছর নতুন নতুন ফলমূল, শাকসবজি দেশে চাষাবাদের তালিকায় যোগ হচ্ছে।

প্রায় চার কোটি টন খাদ্য উৎপাদন করে বাংলাদেশ এখন দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দশগুণ। দেশে ফসল বহুমুখীকরণের পাশাপাশি ফসলের নিবিড়তা বেড়ে হয়েছে প্রায় দুইশ' শতাংশ। অর্থাৎ জমিতে বছরে গড়ে দু'টি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়াও ছাদ-কৃষি ও নগরকৃষিতে মানুষের আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা আশাব্যঞ্জক। এ সামগ্রিক সাফল্যের মূলে রয়েছে যুগোপযোগী পরিকল্পনা, কৃষকের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম এবং মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াস।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজি'র ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার ১০টি গোল এবং এর অন্তর্গত ৩৩টি টার্গেটের সঙ্গে কৃষি খাতের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। কৃষি সংশ্লিষ্ট এসডিজি'র সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহ হলো- সবার জন্য সারা বছর নিরাপদ, পুষ্টিসম্পন্ন ও পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করা। ক্ষুদ্র ও দরিদ্র কৃষকদের আয় ও খামারের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা। টেকসই খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা। ফসলসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের কৌলিসম্পদ সংরক্ষণ করা। কৃষি গবেষণা, সম্প্রসারণ ও পলস্নী উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা এবং সেচকাজে পানিসম্পদের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করা। তাই টেকসই উন্নয়নের জন্য এসডিজি'র উপরোক্ত উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়ন অপরিহার্য।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণ ঘটিয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো উৎপাদনের গুণগতমান নিশ্চিত করে রপ্তানিমুখী কৃষিতে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান করে নেয়া। আমরা বলে থাকি- কৃষিই কৃষ্টি, কৃষিই সমৃদ্ধি। কৃষকরাই এ দেশের প্রাণ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্য ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। এ বর্ধিত তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান করতে হলে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমরা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করেছি, এখন আমাদের পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে অধিকতর মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। প্রতিযোগী দেশসমূহের সঙ্গে সক্ষমতা তৈরি করে বিদেশে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে