শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এক কোটি ৬৪ লাখ ইঁদুর মেরে ৫০০ কোটি টাকার ফসল রক্ষা

২০২২ সালে এক কোটি ৬৪ লাখ ৫৮ হাজার ৯২৯টি ইঁদুর নিধন করে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৪২ টন ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। এসব ফসলের বাজারমূল্য প্রায় ৪৯৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। প্রতি বছর দেশে ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়। এর আগে ২০২১ সালে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫১৮টি ইঁদুর নিধন করে ১ লাখ ১ হাজার টন ফসল বাঁচানো সম্ভব হয়।
ফিরোজ আখতার
  ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রম্নত এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চল। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০২২ সালে এক কোটি ৬৪ লাখ ৫৮ হাজার ৯২৯টি ইঁদুর নিধন করে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৪২ টন ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। এসব ফসলের বাজারমূল্য প্রায় ৪৯৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। প্রতি বছর দেশে ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়। এর আগে ২০২১ সালে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫১৮টি ইঁদুর নিধন করে ১ লাখ ১ হাজার টন ফসল বাঁচানো সম্ভব হয়। তবে সরকারি-বেসরকারি খাদ্যগুদাম, পাউরুটি ও বিস্কুট তৈরির কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা পণ্য বিক্রির দোকানে বিপুল পরিমাণে খাদ্য ইঁদুর নষ্ট করলেও তার কোনো হিসাব সরকারিভাবে করা হয় না।

কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমণে বছরে উৎপাদিত আমন ধানের শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ, গমের ৪ থেকে ১২ ভাগ, গোল আলুর ৫ থেকে ৭ ভাগ ও আনারসের ৬ থেকে ৯ ভাগ নষ্ট করে। সব মিলিয়ে ইঁদুর গড়ে মাঠ ফসলের ৫ থেকে ৭ শতাংশ ও গুদামজাত শস্যের ৩ থেকে ৫ শতাংশের ক্ষতি করে। সেচনালা নষ্ট করে ৭ থেকে ১০ ভাগ। এসব কারণে ধান উৎপাদনকারী প্রতিটি দেশে কৃষক, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ইঁদুরকে বড় ক্ষতিকারক প্রাণি হিসেবে বিবেচনা করেন। পচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা এই ভাড়ারের দেশে ধানের সঙ্গে কৃষক ও ইঁদুরের সম্পর্ক স্থাপনে জীবনানন্দ দাশ যে চিত্রকল্প এঁকেছিলেন- তা এ রকম সবুজ ধানের নিচে মাটির ভিতরে/ইঁদুরেরা চলে গেছে; আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা;/শস্যের খেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী ইঁদুরের উৎপাত নিয়ে করা এক গবেষণার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের উপকূলীয় লোনা ও মিঠা পানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল পরিবেশ। ফসলের মাঠ ছাড়াও এই অববাহিকায় অবস্থিত হাটবাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি। বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। ইরির আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান-গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে, খাবার- ডিম ও বাচ্চা খেয়ে বছরে খামারপ্রতি প্রায় ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি করে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) ২০১৩ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যে পরিমাণ ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে, তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০ থেকে ৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে দেশে মোট ১৮ প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায়। ফসলের ক্ষতিসাধনকারী একেকটি কালো ইঁদুরের ওজন ১৫০ থেকে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর বড় কালো ইঁদুরের ওজন আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত হয়। একটি ইঁদুর প্রতিদিন তার ওজনের ১০ ভাগ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। আবার সমপরিমাণে খাদ্য কেটে নষ্ট করে। ইঁদুরের মলমূত্র ও লোম খাদ্যের সঙ্গে মিশে মোট ৩০ ধরনের রোগ ছড়ায়। ইঁদুরের বংশবিস্তারের হারও খুব বেশি। একেকটি ইঁদুর দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত বাঁচে। এরা প্রতি মাসেই বাচ্চা দিতে পারে। প্রতিবারে এরা ছয় থেকে আটটি বাচ্চা দেয়। সন্তান জন্ম দেওয়ার দুই দিনের মাথায় এরা আবারও গর্ভধারণ করতে পারে।

গ্রামাঞ্চলে সাধারণত ভূমিহীন ও দরিদ্র মানুষরাই খেতে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহের কাজ করেন। বিশেষ করে হেমন্তে আমন ধান কাটার মৌসুমে অনেক নারী ও শিশুকে ধান সংগ্রহ করতে দেখা যায়। কেউ কেউ ১০-১২ দিনে ২৫-৩০টি গর্ত খুঁড়ে ৩-৪ মণ ধানও সংগ্রহ করে থাকেন। তা দিয়ে তাদের বেশ কিছুদিনের খোরাকি হয়ে যায়।

ইঁদুর গম ফসলে শতকরা ৩ থেকে ১২ ভাগ, আমন ধানের শতকরা ৫-৭ ভাগ ফসল নষ্ট করে। এরা বছরে ধান ও গমের প্রায় ৫০০ টন পর্যন্ত ক্ষতি করে থাকে- যার মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকার ও বেশি। তাছাড়া ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে, খাবার খেয়ে ডিম ও ছোট মুরগি খেয়ে প্রতি বছর খামারপ্রতি প্রায় ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি করে থাকে। প্রতি বছরে প্রায় ৫০ হাজার টন গুদামজাত শস্য ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি হয়ে থাকে। ইঁদুর মাঠের দানাজাতীয়, শাকসবজি, মূল জাতীয়, ফল জাতীয় ফসলের ক্ষতি করে থাকে। আবার গুদামঘরে সংরক্ষিত ফসলেরও মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে (প্রায় শতকরা ২০ ভাগ)। এরা যে শুধু ফসলেরই ক্ষতি করে তা নয়। বই খাতা, কাপড়, আসবাবপত্র, বিছানাপত্র ইত্যাদি কেটে নষ্ট করে। ইঁদুর প্রায় ৩০ প্রকার রোগ ছড়ায়। এছাড়া এরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ নালায় গর্ত করে নষ্ট করে, অনেক সময় বৈদু্যতিক সরঞ্জামাদি কেটে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটায়।

বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি ধান উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। খাদ্যনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রির প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে দ্রম্নত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিকারী দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিকে থাকলেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বালাইয়ের কারণে প্রতি বছর খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। খাদ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দানাদার ফসল উৎপাদন ও রক্ষার যাবতীয় কৌশল সুচারুভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ধান ফসল উৎপাদন ও রক্ষার বিষয় আলোচনা করতে হলে ইঁদুরকে বাদ রেখে সম্ভব নয়। কারণ উৎপাদন ও গুদামজাতকরণ উভয়ক্ষেত্রেই ইঁদুর খাদ্য প্রাপ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। উৎপাদন বৃদ্ধি ধরে রাখতে গিয়ে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো এবং অতিরিক্ত উৎপাদন উপকরণ ব্যবহারের ফলে অন্যান্য বালাইয়ের মতো ইঁদুরের প্রকোপও বেড়ে গেছে।

এশিয়ায় বছরে ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাবার নষ্ট করে ইঁদুর। বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৫৪ লাখ লোকের খাবার নষ্ট করে। ইঁদুরের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ফিলিপাইন। দেশটির উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশ ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। এরপরই লাওস। দেশটির প্রায় ১৫ শতাংশ ধান ইঁদুরের পেটে যায়। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮৬টি ইঁদুর মারা হয়। এর ফলে, দেড় লাখ টন ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। যার বাজারমূল্য ২২২ কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান ও গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে এবং নষ্ট করে। ইঁদুর প্রতিদিন তার ওজনের ১০ ভাগ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। আবার সমপরিমাণে খাদ্য কেটে নষ্ট করে। ইঁদুরের মলমূত্র ও লোম খাদ্যের সঙ্গে মিশে মোট ৩০ ধরনের রোগ ছড়ায়। ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে মুরগির ডিম ও ছোট্ট বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অমেরুদন্ডীয় প্রাণী বিভাগের হিসাবে ইঁদুর দেশের প্রতিটি মুরগির খামারে বছরে ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে। প্রতি বছর ৫০ হাজার টন গুদামজাত খাদ্য নষ্ট করে থাকে।

ধান উৎপাদনকারী এশিয়ার প্রতিটি দেশে কৃষক, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ইঁদুরকে ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এসব দেশে শুধু ধান কর্তন থেকে গুদামে রাখা অবস্থায় ২-২৫ ভাগ পর্যন্ত ইঁদুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। প্রতি ধান মৌসুমে একটি স্ত্রী ইঁদুর অনুকূল পরিবেশে প্রায় ২৪টি বাচ্চা দিতে পারে। এ পর্যন্ত দেশে ১৮ প্রজাতির ইঁদুর শনাক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ইঁদুরের মধ্যে কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত মাঠের ইঁদুর ও ছোট লেজযুক্ত ইঁদুর ধানের ক্ষতি করে। মাঠ ফসলের ক্ষতিসাধনকারী একটি কালো ইঁদুরের ওজন ১৫০ তেকে ২৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। আর বড় কালো ইঁদুরের ওজন আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের মধ্যে কালো ইঁদুর মাঠে ও গুদামে এবং মাঠের বড় কালো ইঁদুর নিচু জমিতে বেশি আক্রমণ করে। মাঠের কালো ইঁদুর ও মাঠের বড় কালো ইঁদুর গ্রীষ্ম মৌসুমে সাধারণত ফসলের ক্ষেত ও গ্রামের বিভিন্ন স্থানে গর্তে থাকে এবং গতের্র মুখ বন্ধ রাখে ও মাটি স্তূপ করে রাখে। একটি গর্তে একটি মাত্র ইঁদুর থাকে। বর্ষার সময় নিম্নভূমি পস্নাবিত হলে এবং ফসলের জমিতে বৃষ্টির পানি জমলেই ইঁদুর গিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়।

সাধারণত আগাম পরিপক্ব ধানের জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। ইঁদুর ধান গাছের কুশি তেরছা কোণে (৪৫ ডিগ্রি) কেটে দেয়। গাছে শীষ বের হলে শীষ বাঁকিয়ে নিয়ে কচি ও পাকা শীষগুলো কেটে দেয়। ইঁদুর ধান ফসলে তিন মৌসুমেই আক্রমণ করতে পারে। তবে আমন মৌসুমে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং পানি সহজলভ্য হওয়া এবং মৌসুমের শেষভাগে বৃষ্টিপাত কম ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ সময়ে ইঁদুরের প্রজনন খুব বেশি হয়। ফলে ইঁদুরের সংখ্যা অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় বেড়ে যায়। ইঁদুরের প্রজনন শুরুর পূর্বেই ইঁদুর নিধন করা দরকার। তাই আমন মৌসুমে ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাস। কারণ এ সময়ে মাঠে ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকে। মাঠে প্রচুর খাদ্য না থাকায় ইঁদুর সহজেই এ সময় বিষটোপ খেয়ে থাকে। আমন ফসল ক্ষতি করার আগেই ইঁদুর মারতে পারলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে না এবং ফসলের ক্ষতিও অনেক কম হয়ে থাকে। ধান রোপণের সময় ও রোপণের ৪৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে (ধানে থোড় আসার পূর্বে) ধানের জমি ও আশপাশের এলাকার এবং জমিতে প্রথম পানি ছাড়ার দিন গভীর ও অগভীর সেচের নালায় ইঁদুর দমনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতির ধরন, এর ব্যাপকতা ও দমন প্রক্রিয়া অন্যান্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও কৌশলগত। তাই স্থান-কাল-পাত্রভেদে কৌশলের সঠিক ও সমন্বিত দমন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করতে হবে। ইঁদুরকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য সবাই মিলে একযোগে বেশি জায়গার ইঁদুর নিধনে ফসল রক্ষা পায় ও ইঁদুরের সংখ্যা পরবর্তী সময়ে আর বাড়তে পারে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে