শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানির ৭৮ শতাংশ ভূগর্ভস্থ

পানির অপর নাম মরণও হতে পারে। এক ফোঁটা নোংরা পানিতে পাঁচ কোটিরও বেশি জীবাণু থাকতে পারে। বন্যা এবং খরা বিশুদ্ধ পানির উৎসকে ধ্বংস করে দেয়- যার ফলে কলেরা, ডায়রিয়া এবং টাইফয়েডের মতো বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত গবেষণামতে, পাইপলাইনের পানির ৮০ শতাংশেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। পুকুর ও টিউবওয়লের পানিতেও এ ক্ষতিকর অণুজীবের অস্তিত্ব মিলেছে। পাকস্থলী ও অন্ত্রে প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়। জৈব ও অজৈব দূষণযুক্ত পানিপান করলে চর্মরোগ, যকৃৎ বিকল, কিডনির কার্যকারিতা ধ্বংস হওয়া, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, কার্সিনোজেন, ফুসফুসের কার্যকারিতা ধ্বংস হতে পারে।
কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন
  ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। দেশে কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানির ৭৮ শতাংশ ভূগর্ভস্থ। বিএডিসির গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশের ডেল্টা পস্ন্যান-২১০০ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত। এসব অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা প্রবল। যার প্রভাবে প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন হেক্টর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যেতে পারে এবং সার্বিক উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে। উপকূলবর্তী জেলাগুলোয় লবণাক্ততা আর উত্তরের জেলাগুলোয় শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদে পানি সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তা ও ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের উওর ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ক্রমবর্ধমান মরুকরণের দিকে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ। পানির অভাবে সেসব অঞ্চলে চাষাবাদের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে।

জীবজগতের অস্তিত্বে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখছে পানি। মানুষের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেনের পরই পানি দ্বিতীয় উপাদান। মানুষের রক্ত ও কোষে পানি, অক্সিজেন ও অনান্য পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে থাকে। মানবদেহে ২৫ শতাংশ অক্সিজেন পানি থেকেই আসে। পৃথিবীর সব ধরনের প্রাণী, গাছপালা, তরুলতা সবাই পানির ওপর নিভর্রশীল। পর্যাপ্ত ও নিরাপদ খাবার পানি মানবাধিকার ধারণার পূর্বশর্ত। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, আগামী দিনে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহই হবে পৃথিবীর অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ। পানি শুধু আমাদের তৃষ্ণাই মেটায় না, প্রতিদিন আমাদের যে পরিমাণ ক্যালরি খরচ হয়, এর ৮০ শতাংশই পূরণ করে দেয় তার পানি। সারা দিন আমরা যত ধরনের খাবার খাই, এর মধ্যে একমাত্র পানিই ক্যালরি, ফ্যাট, শর্করা ও চিনিমুক্ত থাকে। শক্তি উৎপাদনে পানির প্রয়োজন, আবার পানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজন শক্তি। বর্তমানে পৃথিবীর ১৬ শতাংশ বিদু্যৎ উৎপন্ন হয় পানিপ্রকল্প থেকে। এ ছাড়া ৮০ শতাংশ শক্তি উৎপন্ন হয় তাপবিদু্যৎ থেকে- যা পানি ছাড়া সম্ভব নয়।

পানির অপর নাম মরণও হতে পারে। এক ফোঁটা নোংরা পানিতে পাঁচ কোটিরও বেশি জীবাণু থাকতে পারে। বন্যা এবং খরা বিশুদ্ধ পানির উৎসকে ধ্বংস করে দেয়- যার ফলে কলেরা, ডায়রিয়া এবং টাইফয়েডের মতো বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত গবেষণামতে, পাইপলাইনের পানির ৮০ শতাংশেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। পুকুর ও টিউবওয়লের পানিতেও এ ক্ষতিকর অণুজীবের অস্তিত্ব মিলেছে। পাকস্থলী ও অন্ত্রে প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়। জৈব ও অজৈব দূষণযুক্ত পানিপান করলে চর্মরোগ, যকৃৎ বিকল, কিডনির কার্যকারিতা ধ্বংস হওয়া, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, কার্সিনোজেন, ফুসফুসের কার্যকারিতা ধ্বংস হতে পারে। ভারী ধাতুমিশ্রিত পানিপান করলে দেহের এনজাইমের কার্যকারিতা নষ্ট, মস্তিষ্ক ও হাড়ের ক্ষয় হতে পারে। শুধু পানিদূষণের কারণেই প্রতিদিন বিশ্বে ১৪০০-এর বেশি এবং বাংলাদেশে প্রায় ৮০ জন মানুষের মৃতু্য হয়।

পৃথিবীর মোট জলভাগের প্রায় ৯৭.৩ শতাংশ হচ্ছে লোনাপানি আর বাকি ২.৭ শতাংশ হচ্ছে স্বাদুপানি। বিশ্বে স্বাদুপানির প্রায় ৬৯ শতাংশ রয়েছে ভূগর্ভে আর ৩০ শতাংশ মেরু অঞ্চলে বরফের স্তূপ হিসেবে জমা আছে এবং মাত্র ১ শতাংশ আছে নদী ও অন্যান্য উৎসে। ভূগর্ভস্থ পানি অধিক উত্তোলনের কারণে প্রাকৃতিক পানিসম্পদের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে। এ চাপ মোকাবিলায় নদী অববাহিকায় উজানের দেশগুলো কৃষি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি সংরক্ষণের জন্য গড়ে তুলছে বিশালাকার বাঁধ বা ড্যাম। উজানের দেশগুলোর বাঁধ নির্মাণের কারণে ভাটি অঞ্চলের দেশগুলোয় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। যার চরম খেসারত দিতে হচ্ছে নিচু অঞ্চলকে। এছাড়া নদীগুলোয় পলি জমা হয়ে নাব্য কমে যাওয়ার কারণে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বের ২৭৬টি নদী অববাহিকার পানি সীমান্ত অতিক্রমী এবং বিশ্ব জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের প্রাথমিক পানির উৎস সীপ্রন্ত-অতিক্রমী এসব নদী। বিশ্বে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক ও সহযোগিতাময় পরিবেশ থাকা জরুরি।

পানির সংকট একটি বৈশ্বিক সংকট। পরিবেশ বিপর্যয়, বিশ্বায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রম্নত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, পানিদূষণ ও অপচয় হলো পানি সংকটের অন্যতম কারণ। এছাড়া যথাযথ অবকাঠামোর অভাব এবং জোরপূর্বক অভিবাসন বা শরণার্থী সংকটও পানি সংকটের জন্য দায়ী। মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ড ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এ সংকট। ওয়াটার এইডের গবেষণামতে, সুপেয় পানি পাচ্ছে না দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। নিরাপদ পানির অধিকারবঞ্চিত বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই চরম দরিদ্র। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে নারী ও শিশু। ২০৩৫ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ চরম পানি সংকটে পড়বেন বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ। এত বিপুল চাহিদার জোগান নিয়ে আতঙ্কে আছে উন্নত বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া তাদের জ্বালানি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির সংকটে পড়তে পারে।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি- যা আগামী শতকে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক প্যানেলের গবেষণা বলছে, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ২০ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি সংস্থাটি সারা বিশ্বের জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির স্বল্পতাকে। লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় পানির প্রবল ঘাটতি আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে। আমেরিকার ওয়াটার ওয়ার্কাস অ্যাসোসিয়েশন তাদের সর্বশেষ গবেষণায় জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনে রয়েছে পানিসম্পদের বিপর্যয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দেশে পানির স্বল্পতা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিবাদ বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে এবং এ কারণে নিরাপদ সুপেয় পানি প্রাপ্তি হবে আগামী বিশ্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সুপেয় পানির পরিমাণই যেখানে দিনদিন কমছে, সেখানে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো এ নির্দিষ্ট পরিমাণ পানিসম্পদের জন্য লড়বেন শিগগির, সেটা নিশ্চিত।

পানি ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে পানির পুনর্ব্যবহার এবং সমুদ্রের পানি নির্লবণীকরণ। এ পদ্ধতি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, ইসরাইলসহ আরও অনেক দেশ সমুদ্র থেকে লবণপানি তুলে পরিশোধন করে নিয়ন্ত্রিত চাষাবাদ করছে। জাপানসহ পৃথিবীর উন্নত দেশে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য দুই ধরনের পানি ব্যবহার করে। সেখানে সরকারি বিধান অনুযায়ী, সব আবাসিক-অনাবাসিক, সরকারি-বেসরকারি ভবনে পানীয় জলের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয় এবং অন্যান্য ব্যবহারের জন্য অপর লাইনে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করা হয়। অনেক ভবনে ব্যবহৃত ভূপৃষ্ঠের পানি ফিল্টার করে পুনর্ব্যবহার করার ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে, ফিল্টার করে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে ৬ নম্বরটি সুপেয় পানি নিয়ে- যা ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। বৈশ্বিক পানি সংকট মোকাবিলা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য পানি, খাদ্য ও পরিবেশগত নিরাপত্তা অর্জন ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ নিরাপদ পানিপ্রাপ্তিকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করার পরও বিশ্বের ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এ সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত আর বাংলাদেশে এ সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ। অনিরাপদ পানীয় জলের কারণে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইউনিসেফ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, নিরাপদ পানির সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুই-তৃতীয়াংশের বসবাস ১০টি দেশে, এর মধ্যে চীন, ভারত, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া, পাকিস্তান, কেনিয়া ও বাংলাদেশ উলেস্নখযোগ্য। পানি ছাড়া মানব অস্তিত্ব অসম্ভব। আন্তর্জাতিক আদালত ও বিভিন্ন দেশের স্থানীয় আদালত পানিকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জলবায়ু সংকট আরও প্রবল হলে বৈশ্বিক সুপেয় পানির সংকট বহুগুণ বেড়ে যাবে। দেশের কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে বিশুদ্ধ পানির অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখন থেকেই পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে।

লেখক: ডক্টর মো. আল-মামুন, কৃষিবিদ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে