সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাকরির পাশাপাশি মাশরুম চাষে বাড়তি আয় করা সম্ভব

বিশ্বে যত স্বাস্থ্যকর খাবার আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মাশরুম। অথচ না জেনে না চিনে ব্যাঙের ছাতা মনে করে আমরা এটিকে কত না অবজ্ঞার চোখে দেখি। মাশরুমের যে কত রকম ঔষধিগুণ আছে তার হিসাব নেই। পুষ্টিমানও অনেক। অন্য যে কোনো সবজির মতো এটিকে খুব সহজেই সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। মাশরুম একটি পুষ্টিকর খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ, উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ আমিষ এবং হজমে সাহায্যকারী এনজাইম রয়েছে।
ইমরান ছিদ্দিকি
  ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বর্তমানে জাপান ও চীনে দীর্ঘ সময় ধরেই ওষুধ তৈরিতে মাশরুম ব্যবহার হয়ে আসছে। পরে ইউরোপ ও আমেরিকাতেও মাশরুম চাষ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও এর চাষ হচ্ছে। বিভিন্ন গুণাগুণের জন্য মাশরুম আন্তর্জাতিক মানের খাদ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। মাশরুম যেমন খেতে সুস্বাদু ও সহজ, তেমন এতে সব ধরনের শরীর গঠনের ও স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মাশরুমকে সুষম খাদ্য হিসেবে সুপারিশ করেছে। মাশরুম অপুষ্টি, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার ও এইডস রোগ প্রতিরোধ করে। ফলে মাশরুমের চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনি মাশরুমের চাষও সম্প্রসারিত হচ্ছে। মাশরুম চাষ করে বেকার সমস্যাও দূর করা সম্ভব।

মাশরুমকে আমরা ব্যাঙের ছাতা বলে অভিহিত করে থাকি। আগাছার মতো যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা এসব ছত্রাক খাবার উপযোগী নয়। অনুরূপ দেখতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের মাধ্যমে যে ব্যাঙের ছাতা উৎপাদিত হয়, তা অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং বিশ্বে সবজি হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই ব্যাঙের ছাতাকে ইংরেজিতে বলা হয় মাশরুম। পৃথিবীর বহু দেশে সু্যপ ছাড়াও এটা অন্যান্য সবজির মতো খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মাশরুম একদিকে যেমন অত্যন্ত কম সময়ে উৎপাদিত হয়, তেমনি এগুলো রান্না করতেও সময় কম লাগে। মাত্র তিন-চার মিনিটেই মাশরুম সিদ্ধ হয়ে যায়। মাশরুম দিয়ে মাশরুম ফ্রাই, আমিষ সমৃদ্ধ সু্যপ, মাশরুম চিকেন সু্যপ, মাশরুম চিংড়ি, মাশরুম স্যান্ডউইচ, মাশরুম সস, মাশরুম পোলাও ও মাশরুম ওমলেট তৈরি করা যায়। বর্তমানে পৃথিবীতে মাশরুম খাদ্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। কারণ, মাশরুমে অনন্য শাকসবজি ও ফলের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি আমিষ থাকায় উন্নত বিশ্বের লোকরা একে সবজি মাংস হিসেবে অভিহিত করে। তাছাড়া রোগমুক্ত স্বাস্থ্যের জন্য তারা নিয়মিত মাশরুম রাখে খাবার তালিকায়।

বিশ্বে যত স্বাস্থ্যকর খাবার আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মাশরুম। অথচ না জেনে না চিনে ব্যাঙের ছাতা মনে করে আমরা এটিকে কত না অবজ্ঞার চোখে দেখি। মাশরুমের যে কত রকম ঔষধিগুণ আছে তার হিসাব নেই। পুষ্টিমানও অনেক। অন্য যে কোনো সবজির মতো এটিকে খুব সহজেই সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। মাশরুম একটি পুষ্টিকর খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ, উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ আমিষ এবং হজমে সাহায্যকারী এনজাইম রয়েছে। মাশরুম পুষ্টিকর এবং ঔষধিগুণসম্পন্ন একটি উৎকৃষ্ট সবজি। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মাশরুম চাষের জন্য উপযোগী। মাশরুম চাষের উপকরণ খড়, কাঠের গুঁড়া, আখের ছোবড়া অত্যন্ত সস্তা ও সহজে পাওয়া যায়। এ সবজিটি ঘরের মধ্যে চাষ করা যায় এবং মাত্র ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই মাশরুম পাওয়া যায়- যা অন্য ফসলে পাওয়া যায় না। চাষাবাদে কোন খরচ নেই বললেই হয়। জমির প্রয়োজন হয় না।

প্রতি ১০০ গ্রাম মাশরুমে থাকে ৩.১ গ্রাম আমিষ, ০.৮ গ্রাম স্নেহ, ১.৪ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ০.৪ গ্রাম আঁশ, ৪.৩ গ্রাম শকর্রা, ৬ মি. গ্রাম কেলসিয়াম, ১১০ মি. গ্রাম ফসফরাস, ১.৫ মি. গ্রাম লৌহ, ০.১৪ মি. গ্রাম ভিটামিন বি১, ০.১৬ মি. গ্রাম বি২, ২.৪ মি. গ্রাম নায়াসিন, ১২ মি. গ্রাম ভিটামিন সি। এছাড়া খাদ্যশক্তি থাকে ৪৩ কেলোরি। সাধারণত মাশরুমে মাছ-মাংসের চেয়ে কিছু বেশি এবং প্রচলিত শাকসবজির চেয়ে দ্বিগুণ খনিজ পদার্থ থাকে। আমিষের পরিমাণ থাকে বাঁধাকপি ও অন্যান্য শাকসবজির চেয়ে চারগুণ। এছাড়াও এতে যে ফলিক এসিড থাকে তা অ্যামিনিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে। বহুমূত্র রোগী এবং যারা মোটা তাদের জন্য মাশরুম একটি উত্তম খাবার। এটা খেতে বেশ সুস্বাদু এবং সহজেই হজম হয়।

মাশরুম চাষ অত্যন্ত লাভজনক। মাত্র ১০ দিনেই খাবার উপযোগী হয়। এটা চাষের জন্য আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সহজলভ্য। বেকার তরুণরা এবং মহিলারা ঘরে বসেই এর চাষ করতে পারেন। অন্যান্য সবজির তুলনায় বাজারে এর দাম অনেক বেশি, এজন্য এটা চাষ করা অত্যন্ত লাভজনক। অভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়াও বিদেশে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। গ্রীষ্মকালে যে কোনো চালা ঘরের নিচে এবং বারান্দায় চাষ করা যায়। বর্ষাকালে পানি প্রবেশ করে না অথচ বাতাস চলাচলের সুবিধা আছে এমন ঘরে এর চাষ করতে হয়। শীতকালে ভেজা স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরে এর চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে স্ট্র মাশরুম এবং শীতকালে ওয়েস্টার জাতের মাশরুম চাষ উপযোগী। বর্তমানে বাংলাদেশে চাষকৃত মাশরুম হচ্ছে কিং ওয়েস্টার, বাটন, শিতাকে, ইনোকি, মিল্কি হোয়াইট, বিচ, স্যাগী, নামেকো, পপলার ও স্ট্র। পৃথিবীতে প্রায় ৩ লাখ প্রজাতির মাশরুম আছে।

খড়ের বেডে মাশরুম চাষ সাধারণত দুধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রথম ১৭ থেকে ২০ দিন ওমঘর ঘরে তারপর ফসল উৎপাদনের জন্য চাষঘরে ২১ দিন থেকে ৪৫ দিন। ওমঘর ব্যবস্থাপনা এবং চাষঘর ব্যবস্থাপনা তথা স্ব স্ব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণই হলো এ চাষের মূল কৌশল। মাশরুম চাষ করতে বীজ, ধানের খড়, পাতলা পলিথিন ব্যাগ, ঝুলন্ত শিকা বা বাঁশ, ছিদ্রযুক্ত কালো পলিথিন সিট, ঘরের উষ্ণতা ও আদ্রর্তা পরিমাপের জন্য হাইগ্রোমিটার, ঘরের উষ্ণতা ও আদ্রর্তা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হ্যান্ড সপ্রেয়ার, জীবাণুনাশক, বেস্নড বা ছোট ছুরি, বালতি, আনুসাঙ্গিক অন্যান্য উপকরণ।

জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে জানা যায়, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং মানুষের পুষ্টির ঘাটতি দূর করতে আশির দশকে জাপানের সহায়তায় দেশে মাশরুম চাষ শুরু হয়। এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হলেও এরপর থেকে ধীরে ধীরে দেশে বাড়তে থাকে মাশরুম চাষ। কার্যক্রম গতিশীল করতে সাভারে মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সেখানে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে নারীদের প্রশিক্ষণে চাষের জন্য অর্থ সহযোগিতার পাশাপাশি বিনামূল্যে স্পন প্যাকেট দেওয়া হয়। দিন দিন এতে বেড়েছে নারীদের অংশগ্রহণ।

মাশরুম এক প্রকার ছত্রাক। এটা একটি সুস্বাদু খাবার। বর্তমানে বাংলাদেশেও মাশরুম খাবার হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে প্রায় ৩ লাখ প্রজাতির মাশরুম রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার প্রজাতি খাওয়ার অযোগ্য। আনুমানিক ১০ হাজার প্রজাতির মাশরুমের ওপর গবেষণা চলছে। এদের ভেতরে মাত্র ১০ প্রজাতির মাশরুম খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ঋষি মাশরুম, গুটি বা বাটন মাশরুম, মিল্ক হোয়াইট মাশরুম, ওয়েস্টার মাশরুম, স্ট্র মাশরুমের চাষ করা হচ্ছে। অধিক পরিমাণ লাভজনক হওয়ায় অনেক লোক মাশরুম চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। মাশরুম চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা। ঘরে বসে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করা যায়। গ্রাম বা শহরের বেকার যুবকরা এই মাশরুম চাষ করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারেন।

পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও ঘরে বসে অল্প মূলধনে মাশরুম চাষ করতে পারেন। গ্রীষ্মকালে প্রতি আড়াই মাসে ৯০ থেকে ১০০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া সম্ভব। শীত ও বর্ষাকালে মাশরুম উৎপাদন অধিক পরিমাণে হয়ে থাকে এ সময় একটি ভালো মানের স্পুন থেকে আড়াই মাসে ২০০-২৫০ গ্রাম মাশরুম উৎপাদন করা যায়। ১০-১২ টাকা মূল্যের এই স্পুনগুলো প্রতি আড়াই মাস পর পর পরিবর্তন করতে হয়। বাংলাদেশের অনেক এলাকায়ই বর্তমানে মাশরুম চাষ করা হয়। এগুলোর মধ্যে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, কুমিলস্না, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহীসহ সারাদেশেই বর্তমানে মাশরুম চাষ করা হচ্ছে। সাভার, টঙ্গীতে অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ করছেন।

এ বিষয়ে কৃষিবিদ আজিজুল ইসলাম বলেন, মাশরুম চাষ আমাদের দেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় দিক। এখান থেকে হাজার হাজার বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হবে। প্রশিক্ষণ নিয়ে যে কেউ শুরু করতে পারেন এই মাশরুম চাষ। আর ঘরে বসে আয় করতে পারেন বাড়তি কিছু টাকা। একজন মানুষ যে কোনো কাজের বা চাকরির পাশাপাশি মাশরুম চাষ করে বাড়তি কিছু আয় করতে পারেন। আবার মাশরুমই হতে পারে তার আয়ের একমাত্র উৎস। এভাবে দেশের অনেকেই মাশরুম চাষ করে নিজের ভাগ্য বদল করেছেন, নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন ও অন্যের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে