মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের সবজি পুষ্টিগুণে ভরপুর

সাজ্জাদ হোসেন
  ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শীতের সবজি পুষ্টিগুণে ভরপুর

শীতের সবজির আসল স্বাদটা কিন্তু শীতেই পাওয়া যায়। পুষ্টিগুণও থাকে অটুট। তাই সারা বছর বিভিন্ন ধরনের সবজি খেলেও শীতের সবজি খাওয়ার মজাই আলাদা। আমাদের দেশে শীতের সময় বাজারে বেশি দেখা যায়- ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, লাউ, মোটরশুঁটি, গাজর, লালশাক, পালংশাক, মুলা, শালগম, শিম, টেমেটো ও পেঁয়াজ কলি প্রভৃতি। পুষ্টিবিদদের মতে, শীতকালীন সবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফলিক এসিড, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন প্রভৃতি। অস্থিক্ষয় রোধে ও শরীরে রক্তকণিকা বা পস্ন্যাটিলেড গঠনে শীতকালীন শাকসবজির ভূমিকা অপরিসীম। ভিটামিন-'সি', ভিটামিন-'এ' এবং ভিটামিন-ই এর ঘাটতি পূরণে খেতে পারেন বেশি বেশি শীতের সবজি। শীতকালীন সবজিতে বিদ্যমান ভিটামিন-'ই' মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যা থেকে রক্ষা করে এবং চুলপড়া রোধ করে। তাই সুস্থ ও সুন্দর থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণে শীতকালীন শাকসবজি গ্রহণ করা উচিত।

ডা. পুষ্ঠিবিদ আফসানা করিম বলেন, শীতের সবজিতে পুষ্টিগুণ বেশি। ফুলকপির মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরকে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থেকে বাঁচায়। বাঁধাকপিতে রয়েছে প্রচুর ফাইবার, যা খাবার হজম প্রক্রিয়া সহজ করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এ ছাড়া এটি ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। শিমে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইবার। এ ছাড়া রয়েছে ক্যালসিয়াম এবং প্রোটিন। গাজর আঁশযুক্ত পুষ্টিগুণে ভরা সবজি। গাজরের বিটা ক্যারোটিন কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ হওয়ায় শরীরের টক্সিন জাতীয় উপাদান দূর করে। শাকসবজির সঙ্গে প্রচুর পানিও পান করুন। মনে রাখবেন সঠিক হাইড্রেশন শারীরিক ক্রিয়াকে সমর্থন করে এবং হজমে সাহায্য করে। যারা উচ্চ রক্তচাপে ভোগছেন, তারা মুলা খেতে পারেন। মুলায় জলীয় পরিমাণ বেশি থাকে। এ কারণে মুলা শরীরকে আর্দ্র রাখে। এ ছাড়া মুলা শকর্রার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, তাই ডায়াবেটিস রোগীরা মূলা খেতে পারেন। মূলা আমাদের সবার পরিচিত তেমনি একটি শীতকালীন সবজি। সাধারণত এই গাছের মূল সালাদ কিংবা তরকারি করে খাওয়া যায়, আবার এর পাতা ও ফুল খাওয়া হয় শাক হিসেবে রান্না করে। কাঁচা মূলা অনেক সময় ঝাঁঝালো স্বাদযুক্ত হয়ে থাকে।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞ সায়লা রহমান বলেন, শীতকালের সবজির মধ্যে ফুলকপি অন্যতম। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভালো উৎস ফুলকপি। ফুলকপির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে- যা ওজন কমাতে সহায়তা করে। ফুলকপির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এতে কোলাইন আছে- যা স্মৃতিশক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফুলকপিতে থাকা উপাদান কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ এবং পরিপাকতন্ত্রকে ভালো রাখতে সহায়তা করে। ফুলকপিতে থাকা ফাইবার রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত যে কেউ ফুলকপি খেতে পারেন। কারণ ফুলকপিতে ক্যালোরির পরিমাণ খুবই কম থাকে।

বাঁধাকপি ভিটামিন সি, ফাইবার এবং ভিটামিন কে'সমৃদ্ধ সবজি। বাঁধাকপিতে থাকা ফাইবার হজমে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি খারাপ কোলেস্টেরল কমায় এবং রক্তে শকর্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমায় বাঁধাকপি। বাঁধাকপিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষের প্রদাহ দূর করে। যারা ওজন কমাতে চান, তারা প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় বাঁধাকপি রাখতে পারেন। বাঁধাকপি ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাঁধাকপিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যআঁশ- যা ওজন কমাতে সহায়তা করে।

শিমে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন, ফাইবার ও ভিটামিন ডি আছে। শিমে পাচক আঁশ থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া কোলন ক্যানসার প্রতিরোধ করে শিম। শিমে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি এই দুটি উপাদান আছে। এই দুটি উপাদান হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। প্রচুর আঁশ থাকায় শিম কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে। যারা ওজন কমাতে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, তাদের জন্য কম ক্যালরিযুক্ত পুষ্টিকর খাবার হিসেবে শিম হতে পারে আদর্শ। এ ছাড়া ফুসফুস ভালো রাখে শিম।

মুলা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ একটি সবজি। ওজন কমাতে খাদ্যতালিকায় মুলা রাখতে পারেন। মুলায় প্রচুর ফাইবার আছে। এতে হজম প্রক্রিয়া সহজ হয়। এ ছাড়া শরীরে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে মুলা। মুলায় আছে পটাশিয়াম- যা শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি পূরণ করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রক্তপ্রবাহ ঠিক রাখে। মুলা খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। এতে আছে অ্যান্থোসায়ানিন- যা হৃদ্‌?যন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া মুলা শ্বাসতন্ত্রকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। মুলায় পটাশিয়াম, ফোলেট এবং ফাইবার রয়েছে। তাই পেটের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সহায়তা করে মুলা।

গাজরের গুণের শেষ নেই। গাজরে থাকা পুষ্টি উপাদান ক্যানসার প্রতিরোধে এবং ক্যানসারের কোষ তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চোখে ভালো রাখে গাজর। বার্ধক্যজনিত দৃষ্টিশক্তির ঝুঁকি কমাতে গাজর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে গাজর। গাজরে থাকা ফাইবারও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। গাজর চুল পড়া কমায়, চুলকে শক্ত ও মজবুত করে। গাজরে ভিটামিন সি ও বিটা ক্যারোটিন সূযের্র অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ত্বকের কোষ রক্ষা করে। গাজর কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। গাজরের আলফা ক্যারোটিন উপাদান হার্টের সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। গাজর স্বাস্থ্যের জন্য আনেক অনেক উপকারী। চোখ ও দাঁতের সুরক্ষায়, লিভার সুস্থ রাখতে ও ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে খেতে পারেন শীতকালীন সবজি গাজর। এতে রয়েছে বিটা-ক্যারোটিন, থায়ামিন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-কে, ফাইবার, ম্যাংগানিজ ও পটাশিয়াম। গাজরে বিদ্যমান বিটা-ক্যারোটিন দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে এবং গাজরে প্রয়োজনীয় ক্যারোটিনয়েড ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। বেশি বেশি গাজর খেলে পেট ভরবে কিন্তু বেশি ক্যালরি যোগ হবে না। তাই শরীরের ওজন কমাতে ও সুস্থ ত্বক পেতে বেশি বেশি গাজর খাবেন।

পুষ্টিগুণে লালশাক ও পালংশাক অন্য শাকগুলোর তুলনায় একটু এগিয়ে। প্রতি ১০০ গ্রাম লালশাকে রয়েছে প্রায় ৩৮০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম; অন্যান্য পুষ্টিগুণও অন্য শাকের তুলনায় লালশাকে বেশি। আর পালংশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি, আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড- যা আমাদের দেহের জন্য জরুরি। পালংশাক আমাদের শরীরে আর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ ছাড়াও হৃদরোগ এবং কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

শীতকালীন সবজি মোটরশুঁটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি; প্রতি ১০০ গ্রামে পাওয়া যায় ১২৫ কিলোক্যালরি। উদ্ভিজ আমিষের বড় ভান্ডার হলো শিম। শিমে আমিষ ছাড়াও স্নেহ ও ফাইবার জাতীয় খাবার অংশ থাকে। শিমের আঁশ খাবার পরিপাকে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য অনেকাংশে দূর করে। রক্তে কোলেস্টেরোলের মাত্রা কমায়- যা হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করে পাকস্থলী ও পিস্নহার বা লিভারের শক্তি বাড়ায়। লিউকোরিয়াসহ মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে, শিশুদের অপুষ্টি দূর করে এবং পুষ্টি প্রদান করে থাকে। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে উন্নত দেশের লোকজন টমেটো ও টমেটোজাত খাদ্য, পালংশাক, মিষ্টিআলু ইত্যাদি খাবার প্রচুর পরিমাণে খেয়ে থাকে। ক্যালরিতে ভরপুর টমেটোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি- যা মানবদেহের হাড় ও দাঁত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

তাছাড়া ভিটামিন-সি এর অভাবজনিত স্কার্ভি ও চর্মরোগ প্রতিরোধে টমেটো বেশ কার্যকরী। টমেটোতে বিদ্যমান অন্য এক উপাদান হলো লাইকোপেন- যা ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এ জন্য টমেটোকে অনেকে অন্ত্রের অ্যান্টিসেপটিক বলে থাকেন। টমেটোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট- যা কিনা প্রকৃতির আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির বিরুদ্ধে কাজ করে।

ব্রোকলি আমাদের দেশের শীতকালীন নতুন একটি সবজি- যা দেখতে অনেকটা সবুজ ফুলকপির মতো। ব্রোকলিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ক্যালসিয়ামসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। এ সবজিটি চোখের রোগ ও অস্থিবিকৃতিসহ প্রভৃতি উপসর্গ দূর করে ও বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

ধনিয়াপাতা এখন সারা বছর পাওয়া গেলেও মূলত এটি শীতকালীন সবজি। ধনিয়াপাতা সরাসরি সালাদ হিসেবে এবং রান্না করে উভয়ভাবে খাওয়া হয়। এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-কে ও ফলিক অ্যাসিড রয়েছে- যা আমাদের ত্বকের জন্য যথেষ্ট প্রয়োজনীয়। ধনিয়াপাতার ভিটামিনগুলো আমাদের ত্বকে প্রতিদিনের পুষ্টি জোগায়, চুলের ক্ষয়রোধ করে, হাড়ের ভঙ্গুরতা দূর করে এবং মুখের ভেতরের নরম অংশগুলোকে রক্ষা করে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে