শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে

প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন
  ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

প্রযুক্তির ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটছে কৃষিতে। উন্নত বিশ্বের হাওয়া লেগেছে বাংলাদেশেও। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা। বীজতলা থেকে উৎপাদন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে রয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। আধুনিক যন্ত্রাংশের ব্যবহারে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা টেকসই হচ্ছে। এখন কম জমিতে চাষাবাদ করে অনেক বেশি ফসল পাওয়া যাচ্ছে। আর এসব প্রযুক্তির বড় অংশই দেশে উদ্ভাবিত।

মোবাইল ফোনে অ্যাপের ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ায় কৃষকের কাজ হয়েছে আরো সহজ। যন্ত্রে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে দিলে যন্ত্র নিজেই ভূমি কর্ষণ করে দিচ্ছে পর্যাপ্ত গভীরতায়, গাছ লাগানো হচ্ছে নির্দিষ্ট দূরত্বে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে যন্ত্র গাছ থেকে ছিঁড়ে আনছে ফল, রেখে দিচ্ছে সঠিক জায়গায়, আক্রান্ত ফসল তুলে ফেলে দিচ্ছে বাইরে। বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও কৃষি বিপণনের জন্য এসব প্রযুক্তির ব্যবহার দরকার। এছাড়া উৎপাদিত খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বর্তমানে অধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন খাদ্য ও ফলের পুষ্টিমান, উপাদান, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা, উৎপাদিত ফসল ও ফলের আকার, আকৃতি, রঙের তারতম্য ও বাহ্যিক আঘাত বা ক্ষত নির্ণয় করা যায়। বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্র, ধ্বনিতরঙ্গ, তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সঠিক ব্যবহার দ্বারা অতি অল্প সময়েই ফলের মিষ্টতা, পানি ও চিনির পরিমাণ, খুঁত, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আকৃতি ইত্যাদি নির্ণয়ের মাধ্যমে গুণগত ও পরিমাণগত বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। প্রয়োজনীয় ও সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা, বিপণন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইওটি ও অধ্বংসাত্মক পদ্ধতির যথোপযোগী ও কার্যকর ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া উন্নত বিশ্বে কৃষিতে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। কীটনাশক ছিটানো থেকে শুরু করে খামার বা জমির ম্যাপিং, অবস্থা, গোটা দেশের ফসলের অবস্থা নিরূপণ ও খামার পরিচালনা পর্যবেক্ষণের জন্য ড্রোনের ব্যবহার অভাবনীয়ভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহার এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।

কৃষির জন্য যে লাঙল-জোয়াল আর হালের বলদ ছিল কৃষকের চাষাবাদের প্রধান উপকরণ সে জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে আধুনিক লাঙল- ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, ব্রডকাস্ট সিডার পাওয়ার রিপার মেশিন। এমনকি ফসল ফলানোর জন্য জমি চাষ, বীজবপন, নিড়ানি, সার দেয়া, কাটা, মাড়াই, ফসল ঝাড়া ও প্যাকেটিং পর্যন্ত সবকিছুই করা হচ্ছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। ফলে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ছে, কমছে উৎপাদন ব্যয়। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফসলের অপচয়ও কম হচ্ছে। ফলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। বর্তমানে দেশে মোট আবাদি জমির ৯০ থেকে ৯২ ভাগ চাষ হচ্ছে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। যদি চাষাবাদের সব পর্যায়ে অর্থাৎ জমি তৈরি থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন পর্যন্ত পুরোপুরি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তাহলে রীতিমতো বিপস্নব ঘটবে কৃষিতে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে জমি চাষের পর বীজ বপন, গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ, শস্য কর্তন, শস্য মাড়াই, শস্য ঝাড়াইসহ অন্যান্য কার্যাবলিতে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে কৃষক দিন দিন কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ নিশ্চিত করতে পারে কম সময়ে, কম খরচে, কম লোকবলের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক শস্যের যথার্থ জোগান। ফসল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে কর্তন-পূর্ব, কর্তনকালীন ও কর্তনোত্তর সময়ে ফসলের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে দানাশস্যে ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ মোট উৎপাদনের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ- যা ফল ও শাকসবজির ক্ষেত্রে প্রায় ২৫-৪০ শতাংশ। এছাড়া এক গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭ শতাংশ গম, ১২.০৫ শতাংশ তৈলবীজ, ২৫ শতাংশ শাকসবজি ও আলু, ১২.০৫ শতাংশ ডাল শস্য এবং ১০.০৫ শতাংশ মরিচ ফসলে কর্তনোত্তর ক্ষতি হয় কেবল দক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করার ফলে। ফসল মাড়াই ও কর্তনের কাজকে সহজ করতে ১৯ শতকের শেষে আসে মাড়াই ও কর্তনযন্ত্রের সমন্বয়ে কম্বাইন হার্ভেস্টার- যা ব্যাপক হারে বাঁচিয়ে দেয় সময়, কমিয়ে দেয় পশু ও মনুষ্য শক্তির ব্যবহার।

১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর আরোপিত শর্তগুলো শিথিল করলে দেশে পাওয়ার টিলার আমদানি বেড়ে যায়। এভাবে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সূত্রপাত হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে জমি চাষের পর বীজবপন, গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ, শস্য কর্তন, শস্য মাড়াই, শস্য ঝাড়াইসহ অন্যান্য কার্যাবলিতে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে কৃষক দিন দিন কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের ফসল উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ফসল থেকে আরেকটা ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাওয়ায় কৃষকরা বছরে বর্তমানে দুটি ফসলের স্থলে তিনটি ফসল পর্যন্ত অনায়াসে চাষ করতে পারছে। এমনকি সুনির্দিষ্ট শস্য বিন্যাস ও স্বল্প জীবৎকালের ফসল নির্বাচন করে যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো কোনো এলাকায় বছরে চারটি ফসল পর্যন্ত করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে দেশে জমি তৈরির ৯৫ শতাংশ কাজ পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দিয়ে করা হচ্ছে। সার প্রয়োগ ও আগাছা দমনের কাজে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং দ্রম্নত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিপর্যায়ে ভাড়ার ভিত্তিতে ফসল কাটার যন্ত্র রিপার বা কম্বাইন হার্ভেস্টার ব্যবহার শুরু হয়েছে। এছাড়া মাড়াই কাজে বিশেষ করে ধান, গম, ভুট্টাসহ সব দানাদার ফসল মাড়াইয়ের কাজে প্রায় ৯৫ শতাংশ যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে।

বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে পাটের রিবন পদ্ধতি বা ছাল পচানো পদ্ধতি কৃষকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। রিবন পদ্ধতিতে পাটের আঁশ ছাড়ানোর পর অল্প পানিতে পাট পচানো হয়- যা পাটের গুণগত মান বৃদ্ধি করে। তাই পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মতো পাট উৎপাদন পদ্ধতিতে ব্যাপকভাবে যন্ত্রের ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া গম, ভুট্টা, আলুসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদ পদ্ধতিও সম্পূর্ণভাবে যান্ত্রিকীকরণের প্রতি সমভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রধান অন্তরায় প্রান্তিক কৃষকের কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের অনুপযোগী ছোট কৃষিজমি, যেখানে মানসম্মত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যায় না। দেশের ক্ষুদ্র কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবেও অসচ্ছল। তাদের উচ্চমূল্যে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সামর্থ্য নেই। এছাড়া ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশ সফলভাবে তার আর্থসামাজিক উন্নয়নকে টেকসই করেছে এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় উচ্চতর সূচক অর্জন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষির আধুনিকায়নে সরকার নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সম্প্রতি সরকার ৩০২০ কোটি (৩০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) টাকার একটি মেগাপ্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে প্রায় ৫৬ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি হস্তান্তর করেছে। খামার যান্ত্রিকীকরণ নীতি-২০২০ অনুসারে কৃষকরা কম দামে কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে সক্ষম হবে এবং সাশ্রয়ী শর্তে স্বল্প সুদে বা সুদমুক্ত ঋণ পেতে সক্ষম হচ্ছে।

বিশ্বের অনেক উন্নত রাষ্ট্রে এখন আধুনিক কৃষি ও খামার ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি যন্ত্রপাতিতে এখন সংযোজিত হচ্ছে মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন ধরনের সেন্সর প্রযুক্তি। পাশাপাশি মাটির পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ আমাদের জানা, জমিতে প্রয়োজনীয় পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, পোকামাকড় ও বালাই ব্যবস্থাপনা, সার ও কীটনাশকের প্রয়োজনীয় ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে জিপিএস ও জিআইএস ট্র্যাকিং পদ্ধতির বদৌলতে। কৃষক এখন ঘরে বসেই জানতে পারছে কখন মাঠের কোন অংশে সেচ দরকার, কোন উদ্ভিদে পোকার আক্রমণ ঘটেছে, কোন ফলটি উত্তোলন উপযোগী, কোন গাভী কতটুকু দুধ দিচ্ছে, কখন দিতে হবে মাছকে খাবার ইত্যাদিসহ নানা তথ্য।

কৃষি যন্ত্রসামগ্রী নির্মাণ দেশের অর্থনীতি এবং কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই খাতটি এখনো ভারী শিল্প হিসেবে চিহ্নিত। কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক বা প্রস্তুত শিল্পকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। দেশীয় বাজারে প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকার কৃষি মেশিনারিজের চাহিদা রয়েছে। কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরি ও রপ্তানিতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে উন্নত মানের কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে। এমনকি চীনের চেয়েও উন্নত মানের মেশিনারিজ তৈরি করছে বাংলাদেশ। ফসল কাটা ও ফসল বপনসহ সিজনের সময় শ্রমের যে মজুরি কৃষককে গুণতে হয় তাতে যন্ত্র ছাড়া কোনো উপায় নেই। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে যেমন অর্থ সাশ্রয় হয়, তেমনি সময় ও শ্রম সাশ্রয় হয়। কৃষিকাজে সবচেয়ে শ্রম ও সময়নির্ভর কাজ হচ্ছে চারা রোপণ, বীজবপন ও ফসল কর্তন। কৃষি ষান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে দানাশস্যের উৎপাদন আরও বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। উন্নত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগে শস্য উৎপাদনের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রাপ্ত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে কৃষক দিন দিন কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে