শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ অল্প সময়ে অধিক লাভ

ইমরান ছিদ্দিকি
  ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ অল্প সময়ে অধিক লাভ

রুই কাতলা, মৃগেল, রাজপুঁটি, সিলভার কার্প ইত্যাদি চাষ লাভজনক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এগুলো চাষ করলে ঝুঁকি কম ও খরচ কম। মাছের মিশ্র চাষ করলে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই বরং অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হবে। মিশ্র মাছচাষ করে উপার্জন হবে লাখ টাকা। কৃষির পাশাপাশি মাছচাষ শুরু করলে তাদের আয় দ্বিগুণ হতে পারে। আজকের যুগে মাছচাষ একটি খুব ভালো ব্যবসা। এই ব্যবসায় একাধিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে- যা কৃষকরা কৃষির পাশাপাশি মাছচাষ শুরু করলে তাদের আয় দ্বিগুণ হতে পারে। আজকের যুগে মাছচাষ একটি খুব ভালো ব্যবসা। এই ব্যবসায় একাধিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে- যা সময় বাঁচায় এবং আয়ও বেশি হয়।

মিশ্র মাছচাষ হলো এমন একটি কৌশল যাতে বিভিন্ন ধরনের মাছ লালনপালন করা হয়, শুধু এই বিষয়টি মাথায় রেখে যে বাছাই করা মাছ পুকুরে উপযুক্ত খাদ্য ও জলের এলাকায় সহজেই বেঁচে থাকতে পারে। মাছ চাষে, কার্পস মাছ এবং ক্যাটফিশ একসঙ্গে বৃদ্ধি পায়। কার্প মাছের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা। এগুলো মৃগাল মাছ ক্যাটফিশ প্রজাতির অধীনে পালন করা হয়। মাছ চাষের জন্য যে পুকুর বাছাই করা হয়, সেখানে পানি প্রবেশের সময় ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে বর্ষাকালে পুকুর ও মাছের কোনো ক্ষতি না হয়। যে পুকুরে আপনি মিশ্র মাছচাষ শুরু করতে চান, তার সমস্ত বাঁধ মজবুত হতে হবে এবং জলের প্রবেশ ও নির্গমন নিরাপদ হতে হবে যাতে বর্ষাকালে পুকুরটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সেইসঙ্গে পুকুরে জলের প্রবেশ এমনভাবে হতে হবে যাতে বিদেশি মাছ পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে এবং পুকুরের জমে থাকা মাছগুলো বাইরে যেতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

পুকুরের পানি সামান্য ক্ষারীয় হলে তা মাছের বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। চালের তুষ এবং সরিষার তেল প্রায়শই মাছের খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এতে কিছু পরিমাণ মাছের গুঁড়া মেশানো হলে এর পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি পায়। এই কৃত্রিম খাদ্য গ্রাস কার্প মাছ ছাড়া বাকি পাঁচ ধরনের মাছের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। গস্নাস কাপের্র অতিরিক্ত খাদ্য হিসেবে হাইড্রিলা এবং ভ্যালিসনেরিয়া জলের উদ্ভিদ এবং বারসিন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।

বিভিন্ন স্তরের খাবার গ্রহণ করে এসব গুণাবলির কয়েক প্রজাতির রুই জাতীয় মাছ একই পুকুরে একত্রে চাষ করাই হলো মিশ্রচাষ। কার্প জাতীয় মাছ বলতে দেশি ও বিদেশি রুই জাতীয় মাছকেই বুঝায়। আমাদের দেশে, দেশি কাপের্র মধ্যে কাতলা, রুই, মৃগেল, কালিবাউশ ইত্যাদি এবং বিদেশি কার্পের মধ্যে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, বিগহেড কার্প, বস্ন্যাক কার্প, কমন কার্প ইত্যাদি অন্যতম। কাতলা, সিলভার কার্প এবং বিগহেড জলাশয়ের উপরের স্তরের খাবার খায়। উপরের স্তরে এসব মাছ সবুজ উদ্ভিদকণা এবং প্রাণিকণা খেয়ে থাকে। রুই মাছ এ স্তরে থাকে এবং ক্ষুদ্র প্রাণিকণা, ক্ষুদ্র কীট, শেঁওলা প্রভৃতি খাবার খায়। মৃগেল, কালিবাউশ, মিরর কার্প অধিকাংশ সময়েই জলাশয়ের নিম্নস্তরের বিচরণ করে। তলদেশের ক্ষুদ্র কীট-পতঙ্গ, শেঁওলা, শামুক, ঝিনুক, ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা এদের প্রধান খাবার। গ্রাস কার্প ও সরপুঁটি সব স্তরেই অবস্থান করে। জলজ উদ্ভিদ, নরম ঘাস, শেঁওলা, ক্ষুদি পানা, টোপা পানা, হেলেঞ্চা, ঝাঁঝি ইত্যাদি গ্রাস কার্পের প্রধান খাবার। ক্ষুদি পানা ও টোপা পানা সরপুঁটির প্রধান খাবার। তাই কোনো জলাশয়ের তলদেশে অধিক পরিমাণ আগাছা, ঘাস, হেলেঞ্চা প্রভৃতি জন্মালে গ্রাস কার্প ছেড়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

অল্প ব্যয়ে জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর নিভর্র যে পদ্ধতিতে মাছচাষ করা হয় তাকে সনাতন পদ্ধতির মাছচাষ বলে। এ পদ্ধতিতে কম অথবা বেশি ঘনত্বে পোনা মজুত করা হয়। পুকুরের রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা হয় না। পুকুরে বাহির থেকে কোনো খাবার ও সার দেয়া হয় না। এ পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি উৎপাদন ও অনেক কম হয়। বৈজ্ঞানিক নিয়মে পুকুর প্রস্তুত করে, নিয়মিত সার এবং সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করে, মধ্যম ঘনত্বে পোনা মজুত করে মাছচাষ পদ্ধতির নাম আধা-নিবিড় পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্রকৃতিক খাবার যাতে বেশি উৎপাদন হয় তার জন্য সার ব্যবহার করা হয়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপন্ন খাবার যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তার জন্য খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তিতে প্রজাতি নির্বাচন করে পুকুরে নির্দিষ্ট ঘনত্বে পোনা মজুত করা হয়। এসব মাছের প্রাকৃতিক খবারের চাহিদা পূরন না হলে বাহির থেকে চাহিদা মাফিক খাবার দেয়া হয়। আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে এই পদ্ধতিতে মাছচাষ করা হয়।

এই পদ্ধতিতে অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে, অধিক উৎপাদনের উদ্দেশ্যে সার ব্যবহার করে প্রাকৃতিক খাদ্য বৃদ্ধি ও বাহির থেকে উন্নতমানের পরিপূর্ণ সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করে উচ্চতর ঘনত্বে পোনা মজুত করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রযুক্তির সর্বাধিক সুযোগ ব্যবহার করা হয়। তাই অন্য দু'পদ্ধতির চেয়ে অনেক ঘনত্বে পোনা মজুত ছাড়া ও নিয়মিত পানি বদল ও বায়ু সঞ্চালনের আধুনিক ব্যবস্থা করা হয়। মাছ চাষের জন্য প্রথমেই যা প্রয়োজন তা হলো পুকুর। ঠিকমতো পুকুর নির্বাচন করা না হলে মাছ চাষে সমস্যা হয়, মাছ ঠিকমতো বাড়ে না, মাছ চুরি হতে পারে, পোনা পরিবহণে অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে। দোআঁশ মাটি পুকুরের জন্য সবচেয়ে ভালো। পুকুরের তলার কাদার পরিমাণ কম হলে সবচেয়ে ভালো। তবে কোনো মতেই ১০ থেকে ১৫ সে.মি.-এর বেশি হবে না। পুকুরের পাড়ে যেন কোনো বড় গাছপালা না থাকে। পুকুরটি যেন খোলামেলা হয়। পুকুরে যেন প্রচুর আলো-বাতাস লাগে। অর্থাৎ দৈনিক ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা সূর্যালোক যেন পুকুরে পড়ে। পুকুর ২০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে হলে ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়। পুকুরের পাড়ের ঢাল ১.৫:২.০ হলে ভালো হয়। স্থান নির্বাচনের খেয়াল রাখতে হবে খুব সহজেই যেন পোনা পাওয়া যায়। পুকুর বসত বাড়ির কাছাকাছি হলে ভালো হয়। এতে পুকুরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার সুবিধা হয়। মাছ চুরির ভয় থাকে না। ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কাছে হাটবাজার থাকলে ভালো হয়।

যে কোনো প্রজাতির মাছ দুই বা ততোধিক এক সঙ্গে চাষ করলেই তাকে মিশ্রচাষ বলা যাবে না। একটি পুকুরে এমন প্রজাতির মাছের চাষ করতে হবে যেগুলো একে অপরের সঙ্গে কিংবা পরিবেশ নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা করে না। মিশ্র চাষের উদ্দেশ্যই হলো পুকুরের সব স্তরের খাদ্যকে সমানভাবে ব্যবহার করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সার দিলে পুকুরের বিভিন্ন স্তরে প্রাকৃতিক খাদ্যের জন্ম হয়। খাদ্যগুলো হলো উদ্ভিদকণা, প্রাণিকণা এবং পুকুরের তলদেশে বসবাসকারী প্রাণীসমূহ। এই প্রাকৃতিক খাদ্যমালা পুকুরে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকে। মিশ্র চাষের আসল উদ্দেশ্যই হলো পুকুরের সব স্তরের খাদ্য ব্যবহার করে অধিক উৎপাদন লাভ করা। পুকুরে পোনা মজুতের পর থেকেই দৈনিক নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। সরিষার খৈল, চাউলের কুঁড়া, গমের ভুসি ও ফিস মিল ইত্যাদি মাছের সম্পূরক খাদ্য। মাছের সম্পূরক খাদ্যে শতকরা ২০ ভাগ আমিষ থাকলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যতা ভেদে সম্পূরক খাদ্যের মাত্রা নির্ভর করে। তবে সাধারণত মজুত পুকুরে প্রতিদিন মাছের ওজনের ৩ থেকে ৫ শতাংশ হারে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। শীতকালে মাছের জৈবিক পরিপাক প্রক্রিয়া কমে যায়, ফলে তাদের খাদ্য গ্রহণের মাত্রা কমে যায়। তাই শীতকালে মাছ কম খায়। এজন্য শীতকালে মাছের ওজনের শতকরা ১ থেকে ২ ভাগ হারে খাবার দিলেই চলে।

গ্রাস কার্প ঘাস খেকো মাছ। তাই গ্রাস কার্পেও খাবার সরবরাহের জন্য পুকুরে চার ফুট লম্বা, চার ফুট প্রস্ত বিশিষ্ট আবেষ্টনীতে সবুজ নরম ঘাস প্রত্যহ সরবরাহ করতে হবে। লাঠি পুঁতে ফিডিং রিংটিকে আটকে দিতে হবে যাতে ফিডিং রিংটি একই স্থানে অবস্থান করে। ফিডিং রিংটি সব সময় পরিপূর্ণ রাখতে হবে। খাদ্যের সঙ্গে সরিষার খৈল ব্যবহার করা হলে পরিমাণমতো উহা একটি পাত্রে সমপরিমাণ পানির সঙ্গে ১২ থেকে ১৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। অতঃপর ওই পঁচা সরিষার খৈলের সঙ্গে পরিমাণমতো অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে আধা শক্ত গোলাকার বলের মতো তৈরি করতে হবে। এ খাদ্য দিনে দুবার অর্থাৎ সকালে ও বিকালে পুকুরের কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে সরবরাহ করতে হবে। সম্ভব হলে খাদ্য পাত্রের মধ্যে সরবরাহ করলে ভালো হয়। শুকনো গুঁড়ো খাবার সরাসরি পুকুরের পানিতে ছড়িয়ে দিলে খাদ্যের অপচয় হয়। এতে মাছের ভালো ফলন পাওয়া যায়।

মাছ চাষের সফলতা অধিকাংশ নির্ভর করে পুকুরে পানির পরিবেশ ঠিক রাখার ওপর। কোনোরকম পচন ক্রিয়া যেন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। তাই যেসব পদার্থ পানিতে পচন ক্রিয়া ঘটাতে পারে তা যাতে পুকুরে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরে গাছের পাতা পড়ে অনেক সময় পানির পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। এর প্রতিকারের জন্য পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। নালা-নর্দমার বিষাক্ত পানি পুকুরে যাতে কোনোক্রমেই প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য কোনো উৎস থেকে আসা পানি, জাল বা অন্য কোনো পাত্র পুকুরের পানিতে ধোয়া উচিত নয়। এ সবের মাধ্যমে পুকুরে রোগবালাই সংক্রমিত হতে পারে। অনেক সময় বাজার থেকে মাছ এনে রন্ধন কাজের জন্য পুকুরে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়, এতে অনেক সময় পুকুরে রোগ সংক্রমণ ঘটতে পারে। পুকুরে বড় মাছ রাখা হলে অধিক লাভ পাওয়া যায় না। তাই বাজারজাতকরণ উপযোগী মাছ ধরে ফেলতে হয়। ইহা ছাড়া পুকুরে সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার অধিক মাছ মজুত রাখা হলে ছোট মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তাই পুকুর থেকে নিয়মিত বড় মাছ ধরে ছোট মাছকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। বড় মাছ ধরে ফেললে পুকুরে বেশি জায়গা হওয়াতে ছোট মাছগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পাবে। এ সব সুবিধার কারণে আংশিক মৎস্য আহরণ করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে