শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে একদিন

ইসমাইল হোসেন
  ০৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

নতুন বছরের শুরুতেই নিজেকে নতুনত্বের সঙ্গে পরিচয় করানোর প্রয়াস চলছে। তবে দিনগুলো কেমন কাটছে তা অনুমান করা দুষ্কর। রাতে ঘুম যাওয়ার আগে ফোন হাতে নিয়েই দেখি বন্ধুর ম্যাসেজ, 'আমরা কয়েকজন মিলে ভাবছি চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ঘুরতে যাবো। তোর কী মতামত?' আগেও অনেকবার যাবো বলেও যাওয়া হয়নি। তাই, বন্ধুর লোভনীয় প্রস্তাবে না রাজি হয়ে পারলাম না।

সবাই মিলে পরিকল্পনা শুরু করলাম। আমরা ৬ জন মিলে ঠিক করলাম ভোর সকালে বের হবো। যেই কথা সেই কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যাল থেকে সবাই মিলে ভোর ৬টায় রওনা হলাম। ক্যাম্পাস থেকে বড়দীঘির ঘাট পার হয়ে দু'পাশের প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে পৌঁছালাম ভাটিয়ারী বাসস্টেশনে। আমার মনে হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো ভাটিয়ারী।

পাহাড়ের পর পাহাড়, ঢেউ খেলানো রাস্তা যেন স্বর্গীয় এক দোলা দিয়ে যায়। আমরা ভাটিয়ারী বাসস্টেশনে নাশতা করে সীতাকুন্ডের উদ্দেশে রওনা করলাম। বরাবরই আমার বাসজার্নি খুব বিরক্ত লাগে। তাই, সবাই মিলে আড্ডা আর গানে নিজেদের সময়টাকে আনন্দময় করার চেষ্টা করতে থাকলাম।

প্রায় ঘণ্টা খনেক যাত্রার পর অবশেষে আমরা সীতাকুন্ডে গিয়ে পৌঁছলাম। ওখান থেকে সিএনজি করে সোজা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গোড়ায়। সঙ্গে করে ব্যাগটা নিয়ে যাওয়ায় প্রায় সবারই কাজে আসছিল ব্যাগটা। বাড়তি কাপড়চোপড় রাখতে পেরেছিলাম তাতে। আর সবাই একটু একটু করে বহন করছিলাম যাতে একজনের জন্য কষ্ট না হয়ে যায়।

আমার এক বন্ধু বলেছিল ওখানে যাওয়ার সময় পানি নিয়ে যাওয়া জরুরি। তাই, দোকান থেকে পানি নিলাম, সঙ্গে হালকা শুকনা খাবারও কিনে নিলাম। কেননা, পাহাড়ের উঁচুতে সবকিছুর দাম একটু বেশিই। আর হবেই না বা কেন? ৩১০ মিটার উঁচুতে খাবার নিয়ে বিক্রি করা অনেক কষ্টের কাজ বটে।

কিছুক্ষণ পরপর আমরা জিড়িয়ে নিচ্ছিলাম? যাতে ক্লান্তি দূর হয়। আর যতটুকু পেরেছি সবে মিলে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়েছি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে যখন দেখলাম বয়োবৃদ্ধ পুরুষ-মহিলারাও পুরো দমে পাহাড় জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও তাদের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট ছিল। যতই উপরে উঠছিলাম ততই যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারাতে লাগলাম।

অবশেষে চন্দ্রনাথের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে সক্ষম হলাম। ক্লান্তিগুলো যেন মুহূর্তেই হার মেনে নিল। সবার ক্লান্তি যেন নিমিষেই মুছে যেতে লাগল। দেখলাম কেউ একজন চূড়ার এক কোণে বসে প্রকৃতি উপভোগ করছে। বেশ ভালো লাগল। মনে হচ্ছিল, যেন সে মতবিনিময় বলছে খোদ প্রকৃতিরই সঙ্গে।

এদিকে অন্যরা স্মার্টফোনে ছবি তোলায় ব্যস্ত। স্মৃতির পাতায় এই চন্দ্রনাথের জন্যও তো একটু জায়গা রাখা দরকার। পাশের বানরগুলো বেশ নজর কাড়ছিল। যেন চন্দ্রনাথের সক্রিয় পাহারাদার। তবে, অতি উৎসাহী হয়ে তার দিকে হাত বাড়াতে যাইনি। জানি, হাত বাড়ালেই সমূহ বিপদ। কেননা, বানরগুলো বেশ পাঁজি। কেউ ছবি তুললেই ফোন কেড়ে নিতে আসছে বানরগুলো।

পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে যতটা না অ্যাডভেঞ্চার করতে হয়েছে, উপরে উঠে সবকিছু বেমালুম ভুলে গেলাম। উপর থেকে পুরো চট্টগ্রাম শহরকে একটা থালার মতো মনে হচ্ছিল। একপাশে সমুদ্র আর পাহাড়ে ঘেরা সবুজ অরণ্য। এ যেন স্বপ্নপুরী। এককোণে বসে দু-চোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো যেন মেঘের রাজ্যে বসে আছি।

চোখের সামন দিয়ে ভেসে যাচ্ছে কতশত মেঘ। পাহাড়ের পর পাহাড়। ভেসে আসছিল পাখিদের কলতান। আহা সে কী উষ্ণতা! এভাবে কতটা সময় মনের অজান্তেই যে কেটে গেল, টেরই পেলাম না। পাহাড় থেকে নামতে একেবারেই মন চাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, থেকে যাই এখানে, গড়ি বসতভিটে।

আর বসে বসে ফের রচনা করি জীবনানন্দের দাসের সেই কবিতার চরণ 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি/তাই আমি পৃথিবীর রূপ/খুঁজিতে যাই না আর'। কিন্তু থাকার সাধ্য যে নেই। নিজের অজান্তেই অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। তাই ইচ্ছে না হলেও ফিরে আসতে হলো আমাদের। এমন একটি ভ্রমণ আমার সারাজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে