শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

নিজ সন্তানের মতো ১৭৫ একরের যত্ন

রুমি নোমান
  ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রূপরস, গন্ধভরা প্রকৃতির সবুজ আবরণে ঘেরা বৈচিত্র্যময় এক অপরূপ ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসটির রাস্তার দুই ধারে সারি সারি শোভাবর্ধনকারী গাছ, চোখ ধাঁধানো বাহারি ধরনের ফুলের গাছের সারির মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয় যে কেউ। সারা দিনের পড়ালেখার ব্যস্ততার পর বিকালবেলা ক্যাম্পাসের সবুজ প্রকৃতির মাঝে ঘোরাঘুরি-আড্ডায় নিমিষেই অবসাদগ্রস্ত মনে সতেজতা ফিরে পান শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়াও ছুটির দিনগুলোতে দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসেন ক্যাম্পাসে সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সবাই ক্যাম্পাসের রূপসৌন্দর্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তবে এই সবুজ শ্যামল ক্যাম্পাসের পেছনে যাদের রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম, যারা নিজেদের সন্তানের মতো যত্ন নিচ্ছেন এই ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য অটুট রাখতে, সেই মালিদের অবদান সবসময় লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। তাদের কাজ সম্পর্কে জানা থাকলেও তাদের নাম এবং অবদান সবসময় আড়ালেই থাকে।

তাদের মধ্যে অন্যতম একজন আলতাফ হোসেন। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) মালি হিসেবে কাজ করছেন তিনি। তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মালি। ক্যাম্পাসের সূচনালগ্ন থেকে মরুসদৃশ ক্যাম্পাসকে বর্তমানের হরিৎক্ষেত্রে আনয়নে দিয়ে গেছেন অসামান্য শ্রম। ৩০ বছর ধরে নিজের সন্তানের মতো যত্ন নিচ্ছেন এই ক্যাম্পাসের। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোপণ করা প্রতিটি গাছের সঙ্গেই রয়েছে তার সম্পর্ক।

জানা যায়, ১৯৯৪ সালে মালি পদে চাকরিতে যোগদান করেন আলতাফ হোসেন। ১৯৯৪ সালে নিয়োগ পেলেও সড়ক ও জনপদ বিভাগের আরবরি কালচারের চুক্তিভিত্তিক কাজের সুবাধে ১৯৯২ সাল থেকেই এখানে কাজ শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করতে করতে ক্যাম্পাসের প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে আটকে ফেলেছেন মায়ার জালে। ক্যাম্পাসের সবুজ প্রকৃতি দেখে নিজে যেমন গর্ববোধ করেন, তেমনি নিজের হাতে গড়া কোনো বৃক্ষ মারা যেতে দেখলে ব্যথিত হন তিনি।

আলতাফ হোসেন বলেন, '১৯৯২ সালে প্রথম ঢাকার আরবরি কালচারের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ মাসের চুক্তিভিত্তিক ডায়না চত্বরের ফুলের বাগানের কাজ করি। পরে ১৯৯৪ সালে তৎকালীন ট্রেজারার আমাকে ঢাকা থেকে ডেকে পাঠালে এসে আবেদনের মাধ্যমে চাকরিতে যোগ দেই। আমি যখন ক্যাম্পাসে আসি তখন ক্যাম্পাস একদম সাদা ছিল। ক্যাম্পাসের এক পাশে দাঁড়ালে অপর পাশ দেখা যেত। সব ছিল ফসলি জমি। ওই রকম সাদামাটা জায়গা থেকে ক্যাম্পাস এখন আজকের এই সবুজ শ্যামল আঙ্গিনায় পরিণত হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসের প্রত্যেকটি জায়গায় যত সারিতে যত ধরনের গাছ আছে, প্রত্যেকটির সঙ্গেই আমি সংযুক্ত আছি। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে করতে ক্যাম্পাসের প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে। সবুজ ক্যাম্পাসের দিকে তাকিয়ে যখন দেখি যে, গাছগুলো আমার লাগানো তখন মনটা জুড়িয়ে যায়। যখন দেখি বাইরে থেকে মানুষ এসে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য উপভোগ করছে, শিক্ষার্থীরা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে তখন মনের মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে পাই, তৃপ্তি অনুভব করি। এখানেই আমার আসল পাওয়া।

এ ছাড়াও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে গাছ মারা যাওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক হারে গাছ কাটার বিষয়ে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, 'অনেক সময় গাছের মধ্যে ব্যানার. পোস্টার টাঙানোর জন্য পেরেক মারা এবং বৈদু্যতিক তারের কারণে অনেক গাছ মারা যায়। যখন দেখি যে, নিজের হাতে রোপণ করা এবং পরিচর্যা করা বিশাল গাছটি মারা যায়, তখন খুব কষ্ট লাগে। একটি গাছ ছোট থেকে বড় করতে অনেক কষ্ট হয়। মেইনগেটের সামনে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল, এসব কারণে ওই গাছটি মারা গেছে। এখন ওই জায়গায় নতুন যে গাছটি রয়েছে, সেটার ওপরও বৈদু্যতিক তার রয়েছে। এসব বিষয় বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশবাদীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক গাছ কাটা পড়ে। কিন্তু যে হারে গাছ কাটা হচ্ছে, সে হারে গাছ লাগানো হচ্ছে না। ফলে ক্যাম্পাস তার সেই পুরনো জৌলুস হারাতে বসেছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি দিতে হবে। একজন মালি তো আর চাইলে উদ্যোগ নিতে পারে না।'

ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সিয়াম কারনাইন বলেন, আলতাফ মামা খুব ভালো মনের মানুষ। তিনি যখন কারও সঙ্গে কথা বলেন তখন হাসিমুখে কথা বলেন। তার ব্যবহার খুবই অমায়িক। ক্যাম্পাসের শুরু থেকেই তিনি এই ক্যাম্পাসের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার মতো মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে কারণেই আমরা এমন সুন্দর ক্যাম্পাস পেয়েছি। এমন ক্যাম্পাসের জন্য আমরা তার মতো মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের অবদানগুলো সবসময় লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। আমাদের সমাজে তাদের যথার্থ মূল্যায়ন করা হয় না। তাই চাই, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে