সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যাম্পাসের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে শৈশব স্মৃতি

নজরুল ইসলাম
  ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

আমি দেব চাল, সে দেবে আলু-ডাল, আরেকজন দেবে পেঁয়াজ-মসলাপাতি, কেফবা দেবে ঝাল-লবণ। ডিম ক্রয়ে মাথাপিছু ধার্য হতো দু-এক টাকা। এভাবেই সংগ্রহ হতো রান্নার সব উপাদান। টাকা-পয়সার সংকট থাকলেও আগ্রহের ঘাটতি ছিল না। যে কোনো নিরিবিলি স্থান, জনবসতিহীন আঙিনা কিংবা বিস্তীর্ণ পুকুরঘাটে বিস্তর ডালপালা-বিশিষ্ট বটবৃক্ষের তলায় পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভিন্নরকম এ আয়োজনে মিলিত হতাম আমরা গ্রামের কয়েকজন বন্ধু। বলেছিলাম আমাদের সেই দুরন্ত শৈশবের স্মৃতিময় চড়ুইভাতির স্মৃতিকথা। গ্রামে আমরা একে ঝোলাভাতি বলতাম। রান্না শেষে সামান্য এ ভোজের মধ্য দিয়ে মেতে উঠতাম হাসি-আনন্দে। বেশির ভাগ আয়োজনই হতো মধ্যাহ্ন ভোজের। ক্ষুধা মিটিয়ে নানা রকম খেলাধুলায় বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও মন যেন বাড়ি ফেরায় গররাজি।

স্মৃতির পাতায় আরও একবার ঝাঁপটা দিল সেই উচ্ছল শৈশব। সেই আনন্দময় চিত্রপটগুলো আবারও আবির্ভূত হলো ক্যাম্পাসের প্রথম চড়ুইভাতির মধ্য দিয়ে। বেশ কিছুদিন থেকে ক্লাস বন্ধ রয়েছে। এই সুযোগ কেউ কেউ বাড়িতে পথ গড়িয়েছে। অনেক দিন ক্লাস বন্ধ থাকায় নিঃসঙ্গতার এই সময়ে এক পশলা উচ্ছ্বাসের বার্তা নিয়ে যেন আগমন ঘটল এ চড়ুইভাতির। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৩১তম ব্যাচের বন্ধুদের উদ্যোগে এই আয়োজন। শরতের শেষে শীতের স্নিগ্ধ ছোঁয়া অনুভূত হতে শুরু করেছে সর্বত্র। শীতের সকালে প্রকৃতি স্বভাবতই আশ্চর্য রূপ ধারণ করে। হাড় কাপানো উত্তরের হাওয়া আর ঘন কুয়াশার ঠান্ডায় প্রভাতের রূপ থাকে থমথমে। তবুও ক'জন শিক্ষার্থী থেমে নেই, তীব্র ঠান্ডায়ও সকাল সকাল ক্যাম্পাসে তাদের উপস্থিতি। পারস্পারিক ভালোবাসা, সহমর্মিতা, আনন্দ-উলস্নাস ও অর্পিত দায়িত্ব যেন তাদের শক্তি আর মনোবলের উৎস হয়ে উঠেছে। কয়েকজন শহরে থাকায় সকাল ৮টার গাড়িতে ক্যাম্পাসে পৌঁছে তারা। এদিকে বাজারের দায়িত্ব পড়েছে বন্ধু খায়েরের ওপর। তার সঙ্গে আছে জিম, আশিক, তানজিল ও ফাহাদ। কাটা মুরগি, পোলাও চাল, ডিম, ডাল ও মসলাপাতি প্রভৃতি নিয়ে আসা হলো। অন্যদিকে হাঁড়িপাতিল, কড়াই, পেস্নটসহ যাবতীয় সামগ্রী ব্যবস্থার দায়িত্ব পড়ল বন্ধু মাসুদ ও রনির ওপর। লাকড়ি সংগ্রহে ছুটল কয়েকজন। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন সকাল ৯টা। কুয়াশার কালোর পর্দা ভেদ করে ঔজ্জ্বল্য ছড়াল সকালের সূর্য। ততক্ষণে মাঠের ঘাস ও গাছের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো রোদের আলোয় মুক্তার মতো চিকচিক করে উঠছে। প্রকৃতির স্নিগ্ধ সতেজতার মাঝে মেসবাহ, অনিক, তুর্কি, অনি, মলি, আয়েশাসহ অনেকেই একত্রিত হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট মাঠের পাশের পেয়ারা বাগানে।

শুরু হলো রান্নার পর্ব। আগে থেকে কেউ কারও রান্নার সম্পর্কে জানা ছিল না। এছাড়া এমন বড় আয়োজনে রান্নার অভিজ্ঞতাও ছিল না কারও। তাই পেশাদার একজন রাঁধুনীকে দেওয়া হলো রান্নার দায়িত্ব। শ্যামলী ও রিনিকে দেওয়া হলো খাবারের স্বাদ পরখের দায়িত্ব। অন্যদিকে সিয়াম, নাঈম, প্রতিভা, শোভা ও জিমের সবজি কাটাকাটির পারদর্শিতা মুগ্ধ করল সবাইকে। পুরো আয়োজনের স্থিরচিত্র ধারণ করতে ডাকা হয়েছে একজন পেশাদার ফটোগ্রাফারকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সবাইকে ক্যামরার ফ্রেমে বন্দি করতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। এ ছাড়াও যে যার মোবাইলে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিতে শুরু করল। নানা রকম কৌতুক-কথা ও হাসি-আড্ডায় মেতে ছিল আয়োজনের শুরু থেকে শেষ অবধি। নিজেদের বাগ্মিতায় আসর জমাতে পারদর্শিতার জানান দিল আদিব, আশিক, রুম্মন ও ফারুকসহ কয়েকজন।

প্রাকৃতিক সবুজে ঘেরা পেয়ারা বাগানটি পাখির কিচিরমিচির শব্দে এমনিতেই প্রাণচঞ্চল থাকে সারাদিন। সেদিন স্বর্ণা, তিথি ও টুম্পার গানের সুর যেন পাখির ডাকের সঙ্গে মিলিত হয়ে বহু গুণ চঞ্চলতা বাড়িয়ে দিল। দুপুর ২টায় রান্না শেষ হলো। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। সবার চোখেমুখে ক্ষুধার ছাপ দৃশ্যমান। অবশেষে সামনে এলো কাঙ্ক্ষিত খাবার। আনন্দের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজ শেষ হলো। রাঁধুনীর দক্ষতার প্রশংসা শোনা গেল সবার মুখে মুখে। খাবার আয়োজন শেষে 'অন্ধের হাঁড়ি ভাঙা' খেলার মধ্য দিয়ে শুরু সাংস্কৃতিক পর্ব। বিচক্ষণতার এ খেলায় প্রথম স্থান অর্জন করল মনিরা। বালিশ খেলায় মূল অস্ত্র ক্ষিপ্রতা হলেও ভাগ্যের ব্যাপারটিও জড়িত। এ দিন ভাগ্যকে নিজের দিকে করে নেয় বন্ধু অনিক। এছাড়াও আরও বেশ কিছু আয়োজনে শেষ হলো এ পর্ব। চারদিক সূর্যের ডুবি ডুবি ভাব। দিনের নিভু নিভু অন্তিম ঘোষণায় বিকাল ঘনিয়ে সন্ধ্যায় উপনীত হলো। বাগানের পাখিরাও আমাদের ছেড়ে নীড়ে যেতে শুরু করল। মুহূর্তে অন্তিম সূর্যিমামা আমাদের যেন জানান দিচ্ছে তোমাদেরও যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। চারদিক ল্যাম্প পোস্টের আলো জ্বলে ওঠল। ক্লিক ক্লিক শব্দে কয়েকটা গ্রম্নপ ছবি তুলল ফটোগ্রাফার। সবার মাঝে তখনো সময় স্বল্পতার আক্ষেপ। কেন সূর্যটা আরও কিছুক্ষণ থাকল না আমাদের সঙ্গে! মনে এই প্রশ্ন আর ঝুলিতে কিছু আনন্দ-উচ্ছ্বাসের স্মৃতি নিয়ে সবাই নিজ নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ালাম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে