শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

শুদ্ধ সংস্কৃতি ও নান্দনিকতার চর্চায় 'ধ্বনি'

হাদীউজ্জামান
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শুদ্ধ সংস্কৃতি ও নান্দনিকতার চর্চায় 'ধ্বনি'

সংস্কৃতির রাজধানী নামে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত বুদ্ধি ও সংস্কৃতি চর্চার এক অন্যতম সম্ভাবনাময় চরণক্ষেত্র। এখানকার মায়াভরা স্নিগ্ধ সবুজ প্রকৃতি মুক্ত প্রাণের সন্ধান করে। প্রাণ প্রকৃতির ছোঁয়ায় বিকশিত হয় সুপ্ত প্রতিভা। এই প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে সবার কাছে আত্মতৃপ্তির এক অন্যতম জায়গা। এজন্যই সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরোই আলাদা।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বিভিন্নভাবে এখানে সাংস্কৃতিক চর্চা চলমান আছে। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন। তেমনি একটি সংগঠন 'ধ্বনি'। এই সংগঠনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবৃত্তি চর্চা ও বোধের জগতের মহাসত্যের উন্মোচন নিয়ে 'দিগন্তে চলো শব্দ যেথায় সূর্যসত্য' এই সেস্নাগানকে ধারণ করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে কবিতা দিগন্তে ছুটে চলা এক মহাসত্য। যার কোনো স্থান-কালের সীমা নেই।

বিকাল হলেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের টিএসসির ৯নং কক্ষে একত্রিত হন। চর্চা করেন বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ, কেউবা কণ্ঠশীলন করেন, কেউবা কণ্ঠের মাধুরী মিশিয়ে নির্মাণ করেন একেকটি কবিতা। শুধু আবৃত্তি চর্চাই নয়, পাশাপাশি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেতে উঠেন নানারকম গল্প-আড্ডা গানে। কণ্ঠের ঝঙ্কারে কম্পিত হয় পুরো কক্ষ। আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হয় সুস্থ সংস্কৃতির নান্দনিক চর্চার ঢেউ।

পড়ালেখার পাশাপাশি আবৃত্তি চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সুস্থ সংস্কৃতি ও সুন্দর মন গড়ে তোলার অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ধ্বনি। ধ্বনির সদস্যরাই এখানে শিক্ষক। খুব সযত্নে অগ্রজরা তাদের স্নেহের অনুজদের আবৃত্তি শাস্ত্রের দীক্ষা দেন। এ যেন প্রাচীন যুগের এক পাঠশালা। গুরুর একান্ত স্নেহধন্য হয়ে শিষ্যরা শিখছেন সুন্দর বাচনভঙ্গি আর শুভ্রবোধের চর্চা।

ধ্বনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আবৃত্তি চর্চায় সারথির ভূমিকা পালন করে আসছে। একঝাঁক আবৃত্তিপ্রেমী ও সংস্কৃতির মননে উজ্জীবিত তরুণের হাত ধরে ধ্বনির পথচলা শুরু ১৯৯৬ সালের ১২ অক্টোবর। সংগঠনটি গণমুখী শিক্ষা চেতনায় বিশ্বাস, আবৃত্তি, বাক উৎকর্ষতা ও শুদ্ধ উচ্চারণ চর্চার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।

তারই ধারাবাহিকতায় সংগঠনটি দলীয় আবৃত্তি প্রযোজনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানারকম সৃষ্টিশীল ও কল্যাণমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতি বছর ধ্বনি তিন থেকে পাঁচ দিনব্যাপী আবৃত্তি উৎসব আয়োজন করে যাতে দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বদের গুণীজন সম্মাননা দেওয়ার পাশাপাশি নিজস্ব প্রযোজনা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমন্ত্রিত আবৃত্তি দলের অংশগ্রহণ, দেশসেরা আবৃত্তিশিল্পীদের অংশগ্রহণ থাকে। উলেস্নখ্য, গত বছর আয়োজিত 'রজতজয়ন্তী আবৃত্তি উৎসব ২০২২'-এ গুণীজন সম্মাননা প্রাপ্ত হোন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। এ বছরও কবি রফিক স্মরণে আবৃত্তি উৎসবের আয়োজন করে সংগঠনটি।

ধ্বনির উলেস্নখযোগ্য প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে- পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে, কপিলা, শেষের কবিতা, পরাণের গহীন ভিতর, হীরক রাজার দেশে, হাজার বছর ধরে, পদ্মা নদীর মাঝি, অসময়ের ইশতেহার, প্রশ্ন রাখি কোথা, তোমার আমার এই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমুখ।

ধ্বনি প্রযোজনায় সবসময় দেশের সাম্প্রতিক সংকট ও সামাজিক বাস্তবতা উঠে এসেছে; সামাজিক নানা বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির উৎকর্ষ সাধন ও মননশীল চর্চার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে আলোড়িত করেছে ধ্বনি বার বারই।

ধ্বনি আবৃত্তি চর্চার পাশাপাশি ক্যাম্পাসের নানা যৌক্তিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১০ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক সংকট ও অন্যায়ের প্রতিবাদমূলক আন্দোলনে ধ্বনির অংশগ্রহণের প্রেক্ষিতে অন্যায়কারীদের দোসররা ধ্বনিকক্ষে অগ্নিসংযোগ করে। ফলে পূর্ববর্তী সব নথি, বই, তথ্যভান্ডার, স্ক্রিপ্টসহ সবকিছু পুড়ে যায়। ধ্বনি একেবারে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেখান থেকে ধ্বনি আবার ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে এবং বর্তমানে একটি নান্দনিক আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র হিসেবে দেশে প্রসিদ্ধ লাভ করে।

ধ্বনির বর্তমান সভাপতি মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ধ্বনি শুরু থেকে কবিতা আবৃত্তি, প্রমিত উচ্চারণ ও শুদ্ধ বাচনভঙ্গি নিয়ে কাজ করে আসছে। ধ্বনি সর্বদা বাংলা ভাষাকে ধারণ করার চেষ্টা করে এবং ভাষাকে নান্দনিক রূপ দিতে কাজ করে থাকে। ধ্বনি বছরব্যাপী নানা আয়োজন করে থাকে। যেমন- আবৃত্তি ও বাক উৎকর্ষ বিষয়ক কর্মশালা, আবৃত্তি উৎসব, মাসিক কার্যক্রম হিসেবে জ্বালো ঐতিহ্যের জ্বালো, দৈনন্দিন রেওয়াজ ও কবিতা পাঠের আসর। এগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা নবীনদের আবৃত্তির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে চেষ্টা করি। আবৃত্তির এই শুভবোধের চর্চা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক- এই কামনাই করি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে