অ্যাই চা গরম! চা গরম! হাঁক ছাড়তে ছাড়তে বুলেট গতিতে এগিয়ে এসে গরম চা ভর্তি ফ্লাক্সটা উঁচু করে ধরে বলল চা লাগব কি স্যার?
খুব একটা ইচ্ছা না থাকলেও মায়াবী চেহারার স্থূলকায় ছোট্ট ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলাম না। বললাম দাও এক কাপ।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম, বাহ্, চা তো খুব ভালো হয়েছে!
আমার কথা শুনে বুলেটের মুখটাতেও বেশ তৃপ্তির ছায়া লক্ষ্য করলাম। বলল, হ স্যার, বেচাও ভালাই হয়, হগলেই কয় খুব ভালা চা আমার!
আমি: তো কেমন বেচাকেনা হয় প্রতিদিন?
বুলেট: অয় তিন চারশ।
আমি: লেখাপড়া জানো কিছু?
বুলেট: না, আমরা গরিব মানুষ পড়ালেহা করুম ক্যামনে?
আমি: কেন তোমার বাবা নেই?
বুলেট: হুনছি আছে, কিন্তু দেহি নাই কুনুদিন।
আমি: মানে?
বুলেট: হুনছি আমার জন্মের আগেই আমার মায়েরে ফালাইয়া চইলা গ্যাছে।
আমি: কোথায়?
বুলেট: ঢাহায় থাহে, আরেকটা বিয়াও করছে।
আমি: তোমার মা কি করেন?
বুলেট: মাইনসের বাড়িত কামকাজ করে।
আমি: থাক কোথায়?
বুলেট: নদীর হেই পাড়ে।
কোমলমতি ছোট্ট শিশু বুলেটের জীবনের করুণ কাহিনী আমাকে যেন আপস্নুত করে তুলছে ক্রমান্নয়ে, ওর সম্বন্ধে আরো অনেক কিছু জানবার আগ্রহটাও আমার বেড়ে যাচ্ছে।
আমি: তোমার নামটি তো খুব সুন্দর, তা নামটি কে রেখেছে?
বুলেট: ওস্তাদে রাখছে।
আমি: এই ওস্তাদটা কে?
বুলেট: আগে যেইহানে কাম করতাম হেই ওস্তাদ।
আমি: কোথায় কাজ করতে?
বুলেট: গ্যারেজে, আমি খুব তাড়াতাড়ি কইরা সব কাজকাম কইরা ফালাইতাম বুইলস্না ওস্তাদে আমারে বুলেট কইতো আর হেই নামডাই এহন চালু হইয়া গ্যাছেগা। আমার খুব ভালা লাগছিল নামডা।
আমি: এমনিতে তোমার আসল নাম কি?
বুলেট: আমার ভালা নাম রাব্বি। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বুলেট ওর মোটর গ্যারেজে কাজ করা কালীন কষ্টের অভিজ্ঞতার কথাগুলো আমাকে নির্দ্বিধায় অনর্গল বলে যাচ্ছিল। কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে আমার চোখের পাতা দুটো ভিজে উঠেছে বুঝতেই পারিনি।
বুলেট: এহন যাইগা স্যার চা বেচতে হইব।
আমি: আচ্ছা যাও, তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম, খুব ভালো লাগল তোমার সঙ্গে কথা বলে। বুলেট বিনয়ের সঙ্গে বলল- না স্যার, অসুবিদা নাই। আমারো ভালো লাগল; অনেক কতা কইতে পাইরা।
পকেট থেকে একটা পাঁচশত টাকার নোট বের করে বুলেটের হাতে ধরিয়ে দিতে চাইলাম, প্রথমে নিতে চাইল না কিছুতেই। আত্মসম্মানী ছেলেটি। অনেক জোরাজুরির পরে হাতে নিল। আমি বললাম, তোমার যেটা মনে চায়, এটা দিয়ে কিনে নিও।
ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির ঝিলিক দিয়ে বুলেট বলল ঠিক আছে।
সালাম দিয়ে একরাশ খুশি নিয়ে জীবিকার তাগিদে বুলেট গতিতে পথ হাঁটা শুরু করল বুলেট। জানি না, এই তপ্ত মরুর পথ হাঁটা ওর মতো শত সহস্র বুলেটের কবে কোথায় গিয়ে শেষ হবে! কবে পাবে অধিকার, আশ্রয় খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষার নিরাপদ জীবনের সন্ধান! এই রকম আরো অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল চলতে চলতে পথে।