সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

ম আকারে 'মা'

শান্তা ফারজানা
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

'ঐ ছোরা, ইধার আ। ইয়ে ক্যায়া হ্যায়!!'

কাবুলি পোশাক পরিহিত লম্বা চওড়া লোকটা। সাদা লালচে গায়ের বরণ। মুখে চাপদাড়ি। জানালার পাশের টেবিলটাতে বসেছিল। বুটের ডাল দিয়ে খাসির গোস্ত আর চিকন চালের ভাত- অর্ডার দিয়ে আরামে বসলো। তার উর্দু ভাষার বর্জ্রাঘাতে দৌড়ে গেল অজিমুদ্দি। সে হোটেলের গস্নাসবয়। যারা খেতে বসে তাদের পানি এগিয়ে দেয়। অজিমুদ্দি দৌঁড়ে আসে।

'জ্বী ছার।

ঐ ছোরা, ইয়ে ক্যায়া হ্যায়! আঁখে নেহি হ্যায় ক্যায়া!'

লোকটা পানির গস্নাসটা ঠেলে দিল। অনেকটা ছুড়ে মারার মতো করে। অজিমুদ্দি ভয়ে ভয়ে তাকালো। তেমন কিছুই নজরে এলো না। কিন্তু লোকটা কী যেন দেখাচ্ছে। বারবার। অজিমুদ্দি দেখতে পায় না বলে লোকটা গালি দিয়ে উঠে। ভালুকের থাবার মতো বড় বড় হাতে তেড়ে আসে মারতে। অজিমুদ্দি কেঁপে উঠে। দৌড়ে গিয়ে গস্নাসটা ধুয়ে আবার পানি এনে দেয়। ম্যানেজার গলা বাড়িয়ে তাকিয়ে থাকে।

কী হইছেরে অজিমুদ্দি!

পানিতে ময়লা ভরসে। ধুইয়া দিসি।

হুম। খেয়াল কইরা, খেয়াল কইরা। ম্যানেজারের হুঁশিয়ারিতে সাদা দাঁত বের করে হাসে অজিমুদ্দি। বয়স বারো কি চৌদ্দ। জ্ঞান হওয়ার পর নিজেকে একাই বুঝেছে। মায়ের মুখটা মনে পড়ে না। তার বয়স যখন দুই কি তিন তখন মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। তারপর বাবা আরেক জনকে জীবনসঙ্গী করে নিলো। পরে রইলো অজিমুদ্দি। নানি-খালারা কোলে পিঠে বড় করে দিল ঠিকই কিন্তু পেটের কষ্টের কথা মুখ ফসকে বলাটা কঠিন ছিল অজিমুদ্দির কাছে। তাই একদিন পাশের বাড়ির ফকরুল মিয়ার সঙ্গে ট্রেনে চেপে চলে এলো ঢাকায়। ফকরুল ভাই-ই এখানে দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। প্রতিদিন কত জাতের মানুষ আসে। কেউ সুন্দর করে হাসে। কেউ কাঠস্বরে কথা বলে। কেউ দুই পয়সা পাঁচ পয়সা দিয়ে যায়। কেউ বা আবার তাকায়ও না। কিন্তু অজিমুদ্দির মনে কোনো কষ্ট নেই। সে বড় হতে চায়। সে বড় হয়ে হোটেলের মালিক হবে। তার হোটেলের সামনে বড় বড় অক্ষরে 'মা' লেখা থাকবে। তার হোটেলে প্রতিদিন পাঁচজন অন্ধ, খোঁড়া, দরিদ্রদের বিনা পয়সায় খাওয়াবে আর তার মতো শিশু শ্রমিক যারা অনাথ, মায়ের রান্নার স্বাদ পায় না; তাদের অল্প টাকায় খাওয়ার সুযোগ করে দেবে- সেই স্বপ্নে চার আনা করে করে জমা করে।

'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে উত্তাল অবস্থা বিরাজ করছে। সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা জানিয়েছে। শিক্ষকরাও একাত্মতা পোষণ করে বলছেন...।' ঘ্যার ঘ্যারে রেডিওতে সংবাদ শুনছিল দুই তরুণ। মাঝে মাঝে উত্তেজিত মনে হয় তাদের। কখনো রাগে ফুসে উঠে। বাইশ কি তেইশ বছর বয়সি হবে তারা। তাদের সামনের পরটা ঠান্ডা হয়ে শক্ত হয়ে যায়। সেদিকে নজর নেই তাদের। ম্যানেজারও আলোচনায় যুক্ত হয়। রাষ্ট্রভাষা দিবস, ৪ ফেব্রম্নয়ারি পতাকা দিবসসহ বিভিন্ন বিষয়ে চলে আলোচনা। কখনো রাগ, কখনো ক্ষোভ ঝরে পড়ে তাদের কণ্ঠে। অজিমুদ্দিও কান পাতে। কয়েকদিন যাবত খেয়াল করছে। বাংলাভাষা-উর্দু ভাষা বলে বলে উত্তেজিত হয়ে উঠছে মানুষ। সকাল বেলায় জাতীয় সংগীত 'পাকসার জমিন সার বাদ' বেজে উঠলেই রেডিও বন্ধ করে দেয় ম্যানেজার। স্পষ্ট ক্ষোভ ফুটে উঠে মুখে।

১৯৫২ সাল। ২০ ফেব্রম্নয়ারি। আকাশে গোধূলির লালচে রেখা। চারিদিকে খাঁ-খাঁ নীরবতা। লোকজন তেমন নেই। কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রেডিও শুনছে। ভাঙা ভাঙা আওয়াজে শুনছে আর আলোচনা করছে। এ কী কথা, বাংলায় কথা বলতে পারব না! স্কুল-কলেজে পড়ালেখাও করতে হবে উর্দুতে! উর্দু কীভাবে রাষ্ট্রভাষা হয়! আমাদের ভাষার কোনো দাম নেই! আন্দোলনকে ভয় পাচ্ছে ওরা। দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করেছে ঢাকা শহরে। সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বে-আইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আরে রাখ, কীসের ১৪৪! কালকে সবাই মেডিকেলের সামনে থাকবি। অজিমুদ্দিও সচল হয়ে উঠে। অজিমুদ্দিরা হোটেলের পাটাতনে ঘুমায়। সে আর সুরত আলী। পাটি বিছিয়ে চাদর গায়ে ঘুমিয়ে যায়। শুয়ে শুয়েই অজিমুদ্দি সুরতকে প্রশ্ন করে,

ব্যাপারডা কী বুঝতাসোস সুরত?

ক তো? কোনডা?

ওই যে ভাষা নিয়ে যে রাগারাগি চলতেছে!

ধুর জানি না। সুরত আলী অন্ধকারে হাত নাড়ায়।

আরে ওই যে, ভাইরা যে খাইতে আয়া কওয়া-কওয়ি করে। ব্রিটিশ সরকার ভাগ হইয়া দুইডা পাকিস্তান হইলো।

কইবার পারি না। বিড় বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে সুরত আলী। সে রুটি বানায়। ভোরে ভোরে উঠতে হয়, ময়দার ময়ান বানাতে হয়। ঝাড়ু দিতে হয়। সে কাজ ছাড়া আর কিছু বোঝে না, বুঝতেও চায় না। মাস শেষে বেতন পেলে টাকাটা বাড়িতে পাঠাতে হয়।

কিন্তু অজিমুদ্দি ঘুমায় না। অন্য একটা রেখা তার চিন্তায় ধারাপাত করে। বড় ভাইদের উত্তেজিত কথায় সে কিছুটা বোঝে। তাদের বাংলা ভাষায় কথা বলা মানা। সরকারের আদেশ। তবে এ দেশের মানুষ তা মানে না। অজিমুদ্দি ভাবে, তাইতো। আমাদের ভাষা তো বাংলা। ম আকারে 'মা'। বলতে কতো ভালো লাগে। আপন আপন লাগে। আর ওই দিনের ওই লোকটা উর্দু ভাষায় কত বকা দিল। শুনতেই খারাপ লেগেছিল। না, বড় ভাইদের সঙ্গে সেও যাবে। মেডিকেলটা চেনে সে।

২২ ফেব্রম্নয়ারি। বেলা ১১টা।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। স্স্নোগান দিতে দিতে একটা মিছিল চলেছে। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো রাজপথ, মানি না মানি না।' গতকাল সরকারের লোকজন ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্রসমাজের মিছিলে গোলাগুলি করেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গুলিবর্ষণে রাজপথে লুটিয়ে পড়লো ছাত্র, ছাত্রী, পথচারী, রিকশাওয়ালাসহ সাধারণ জনগণ। শহীদ হয়েছেন অনেক ছাত্র, অনেক ছাত্রী, সাধারণ মানুষ। গুলির আঘাতে অনেকের হাত উড়ে গেছে; উড়ে গেছে পা-ও। চরমভাবে আহত হয়েছেন অনেকেই। আজকেও শাসকচক্রের ঘাঁটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে। তবুও দমন করা সম্ভব হলো না বাংলাভাষা প্রেমীদের। ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গণ ঘিরে চলে ছাত্র-জনতার উত্তপ্ত মিছিল। ভিক্টোরিয়া পার্ক, নবাবপুর রোড, বংশাল রোডেও মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসে ছাত্র-যুব- জনতা। কাঁটাতার, স্টেনগানের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে আসতে থাকে ছাত্রদের মিছিল।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। অ আ ক খ . . .

মিছিলে স্স্নোগান দিতে দিতে সবার সঙ্গে এগিয়ে যায় বারো বছর বয়সি অজিমুদ্দি। তার মনে আন্দোলিত হয় 'ম আকারে মা', 'ম আকারে মা'. . .। তার নিজের হোটেলের চারিদিকে থাকবে লাল গোলাপি হলুদ ফুলের বাগান। গরিব অসহায় মানুষকে অজিমুদ্দি বিনামূল্যে-স্বল্পমূল্যে নিজের হাতে ভাত বেড়ে খাওয়াবে। কারো কষ্ট সহ্য হয় না তার। সবাই মিলে মিশে থাকবে। তার হোটেলের সাইনবোর্ডে বড় বড় সোনালি অক্ষরে লেখা থাকবে 'মা'। তাহলে উর্দু ভাষায় ওরা কেন কথা বলবে? মায়ের ভাষা বাংলা। ওরা বাংলা ভাষাতেই হাসবে, বাংলা ভাষাতেই কাঁদবে। অজিমুদ্দি সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও জোরে জোরে স্স্নোগান তুলতে থাকে.... রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। অ আ ক খ। আ-মরি বাংলা ভাষা। হঠাৎ মিছিলে গুলি ছুড়ে মারতে শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। তবুও দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলে মিছিল। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে একে একে লুটিয়ে পড়ে ভাষাপ্রেমীরা। হঠাৎ একটা গুলি এসে বিঁধে অজিমুদ্দির কপালে। ঠিক দুই চোখের মাঝখানে। গলগল করে রক্ত বেরুতে শুরু করে ছিদ্র থেকে। ভিজে যায় অজিমুদ্দির চিবুক, গলা, বুক, শার্ট সব। তরতাজা লাল রক্তে ভিজে যায় ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গণের ধূলিধূসরিত রাজপথ। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে বারো বছর বয়সি কিশোর। লুটিয়ে পড়ে তার স্বপ্নও। আকাশে বাতাসে তখনো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে 'ম আকারে মা' 'ম আকারে মা' . . .

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে