শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫ ধারা জাস্টিস অব দ্য পিস

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ২৫ ধারায় বিধান অনুযায়ী, পদাধিকারবলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা সারা বাংলাদেশের জন্য, দায়রা বিচার, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে জাস্টিস অব পিস হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।এর পূর্বেও নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সঙ্গে কুষ্টিয়া জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম তানভীর আরাফাত অনৈতিক ও বেআইনি কার্যকলাপ, আক্রমণাত্মক ও বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ দ্বারা ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সরকারি দায়িত্ব পালনে পদমর্যাদার অপব্যবহার করেছিলেন। মহামান্য হাইকোর্ট প্রথমদিকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিলেও অদৃশ্য কারণবশত কজ লিস্ট থেকে মামলাটি হারিয়ে যায়
ম অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ৩০ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

খবরটি পড়ে চোখ আটকে গেল। মন খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপের গল্পটি দিয়েই লেখাটি শুরু করি। সুনামগঞ্জ আদালতে বিচারকের সঙ্গে পুলিশের এক কনস্টেবল ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করায় কাঠগড়ায় আটক রাখার আদেশ দিয়ে বিচারক নিজেই কিছু সময়ের জন্য আটক হয়ে গিয়েছিলেন। আটক পুলিশ সদস্য পিন্টুকে ছাড়িয়ে নিতে কোর্টে দায়িত্বরত অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা এজলাস কক্ষ ঘেরাও করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় বিচারকের নাম ধরে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে।

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে এজলাস কক্ষের সব দরজা বন্ধ করে চলে বিচার কার্যক্রম। এর প্রতিবাদ করলে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের সঙ্গেও বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে পুলিশ সদস্যরা। সুনামগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৩য় আদালতে গত ৮ আগস্ট দুপুর ২ ঘটিকার সময় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে সুনামগঞ্জ আইনজীবী সমিতি কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক এক প্রতিবাদের আয়োজন করা হয়।

পাঠক! নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে, পুলিশপ্রধান শাহীদুল হকের চাকরিচু্যতির গল্পের কথা। সেই ২০০৩ সালের ১৯ জুন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সরকারি গাড়িযোগে বনানী কামাল আতাতুর্ক এলাকা অতিক্রম করছিলেন। সে সময় পুলিশ সার্জেন্ট বিচারপতি মহোদয়ের গাড়ি থামিয়ে পুলিশের নীল রঙের একটা জিপ গাড়ি আগে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। একই সঙ্গে পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে স্যালুট প্রদান করেন। বিষয়টি লক্ষ্য করে বিচারপতি মহোদয় গাড়ি থেকে নেমে সার্জেন্টের কাছে জিজ্ঞেস করেন, সুপ্রিম কোর্টের লোগো সংবলিত গাড়ি ও কালো পতাকা দেখে সালাম না করার কারণ কি? সার্জেন্ট বলেন যে, 'আমরা সুপ্রিম কোর্টের পতাকা স্যালুট করতে বাধ্য নই। আমাদের অত ঠ্যাকা পড়ে নাই!' বিষয়টি নিয়ে সার্জেন্ট সোয়েবুর রহমান বিচারপতি মহোদয়ের সঙ্গে তর্কে জড়ান। পরে আশপাশে থাকা আরও কয়েকজন পুলিশ সার্জেন্টকে ডাকেন সোয়েবুর রহমান। ৫ জন পুলিশ অফিসার জুডিশিয়ারি নিয়ে নানাভাবে কটূক্তি করেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ৩০ জুন ২০০৩ ওই পাঁচজন পুলিশ অফিসারকে সশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন।

একই সঙ্গে আইজিপি এবং পুলিশ ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপালকে ১২ জুলাই ২০০৩ তারিখের মধ্যে নির্দেশ দেন চারটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। প্রশ্নগুলো ছিল এরকম, (১) সার্জেন্ট শোয়েবের আদালতের প্রতি অবমাননার উক্তিতে পুলিশ সদস্যদের ট্রেনিং কলেজে আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কি জাতীয় ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে? (২) সবর্ যাংকের পুলিশ কর্মকর্তা মহামান্য হাইকোর্টের লোগো সংবলিত গাড়ি বহনকারীকে স্যালুট দিতে বাধ্য কিনা? (৩) ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বিষয়ে সব পুলিশ কর্মকর্তা সব ইভেন্টে অনুসরণ করতে বাধ্য কিনা? ও (৪) পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণে এমনটি শেখানো হয়েছে কিনা যে, কম গুরুত্বহীন ব্যক্তির গাড়িকে আগে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।

এই নির্দেশনা দেওয়ার কিছুদিন পরে অস্থায়ী বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় তিনি আর বিচারপতি হিসেবে চাকরিতে ছিলেন না।

তবেপুলিশপ্রধান চারটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ডিউটিরত অবস্থায় পুলিশ সার্জেন্ট বিচারপতিকে সালাম দিতে বাধ্য ছিলেন না। যে বিচারপতি ওই আদেশ দিয়েছিলেন সে এখন আর চাকরিতে নেই। ওই বিচারপতিকেই বরং দেশের প্রচলিত আইনে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার ও পুলিশ অফিসারকে হুমকি দেওয়ার জন্য বিচার করা উচিত। একই সঙ্গে আইজি বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতে কটূক্তি করেন।

জবাবের কপি আমলে নিয়ে বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন এবং বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহম্মেদ স্বপ্রণোদিতভাবে আইজিপির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইসু্য করেন। একই সঙ্গে আইজিপিকে সশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। আইজিপি সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। হাইকোর্ট ডিভিশন আইজিপি শাহাদুল হকসহ চারজন পুলিশ অফিসারের জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা প্রদান করেন।

হাইকোর্ট ডিভিশনের আদেশের পরে দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা অভিমত দেন, দি পাবলিক সার্ভেন্ট অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৫ অনুযায়ীপুলিশপ্রধান শাহাদুল হকের চাকরিতে থাকার সুযোগ নেই। রায় প্রদানের সময় আইজিপি ফ্রান্সে ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে ছিলেন একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সে যখন দেশে আসেন সে সময় তাকে বিমানবন্দরে পুলিশপ্রধান হিসেবে প্রোটোকল দেওয়া হয়নি। তাকে সাময়িক পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ডিএমপির কমিশনারকে চার্জে রাখা হয়। পরে সাসপেন্ড করা হয়। হাইকোর্ট ডিভিশন এ রায়ে জুডিশিয়ারির মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবজারভেশন প্রদান করেন। পরে কলেবরে পাঠকের জ্ঞাতার্থে ওই পর্যবেক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করা হবে।

হাইকোর্ট ডিভিশন সুস্পষ্টভাবে বলেন, সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুলিশসহ নির্বাহী বিভাগ আদালতকে সহায়তা করতে বাধ্য। তাছাড়া আদালত বলতে কেবল গম্বুজাকৃতির বিল্ডিংকেই বোঝাবে না, বরং ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫ ধারা অনুয়ায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির এখতিয়ার সমগ্র বাংলাদেশ। সমগ্র বাংলাদেশেই এখতিয়ার প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় পুলিশপ্রধানসহ বিবাদীপক্ষ। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ে হস্তক্ষেপের কোনো যুক্তি না থাকায় আপিল খারিজ করে দেয়।

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ২৫ ধারায় বিধান অনুযায়ী, পদাধিকারবলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা সারা বাংলাদেশের জন্য, দায়রা বিচার, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে জাস্টিস অব পিস হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।

এর পূর্বেও নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সঙ্গে কুষ্টিয়া জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম তানভীর আরাফাত অনৈতিক ও বেআইনি কার্যকলাপ, আক্রমণাত্মক ও বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ দ্বারা ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সরকারি দায়িত্ব পালনে পদমর্যাদার অপব্যবহার করেছিলেন। মহামান্য হাইকোর্ট প্রথমদিকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিলেও অদৃশ্য কারণবশত কজ লিস্ট থেকে মামলাটি হারিয়ে যায়।

পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্স হয়। সেখানে পুলিশ সুপার বেশির ভাগ সময়েই উপস্থিত থাকেন না। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠে না, চিঠি লেখে না। বিচারক-আইনজীবী কনফারেন্স কখনো হয় না। বিচারকরা নিজেদের ব্রাক্ষ্ণণশ্রেণির মনে করেন। কখনো কখনো আইনজীবীদের প্রতিপক্ষ মনে করেন। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কাঠগোড়ায় বসিয়ে রাখেন। ঠুনকো অভিযোগে আইনজীবীদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তবে এবার আনন্দের সংবাদ এই যে, বিচারকের সাথে এমন আচরণে আইনজীবীরা প্রতিবাদ করেছেন। আশা করি, আইনজীবীদের সঙ্গে পুলিশের এহেন আচরণে বিচরকরাও সোচ্চার হবেন।

এ বিষয়ে অতীতের মতো দেশের সর্বোচ্চ আদালত কি ব্যবস্থা নেন সেই প্রতীক্ষার পথ চেয়ে...।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইনের শিক্ষক।

ই-মেইল: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে