সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

কলাবাগানে আলোচিত নবজাতক হত্যা মামলা বিনামূল্যে আইনি লড়াই এবং গৃহকর্মী মর্জিনার জামিন পাওয়ার গল্প

সিআরপিসির ৫৪ ধারায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশের কাছে অপরাধ সংঘটনের ঈৎবফরনষব ওহভড়ৎসধঃরড়হ এবং জবধংড়হধনষব ঝঁংঢ়রপরড়হ-এর বস্তগত উপাদান বিদ্যমান থাকতে হবে। একটি শিশু নিহত হওয়ার সাত দিন পর তার মায়ের দাবি যে তার ওপর জিন আছর করে বলল, তার বাচ্চাকে মর্জিনা হত্যা করেছে কাজেই তাকে গ্রেপ্তার করো! জিনের দেয়া তথ্য কি করে একজনকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ঈৎবফরনষব ওহভড়ৎসধঃরড়হ হতে পারে? যেই শিশু তার পিতামাতার সঙ্গে লকড রুমে হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃতু্যবরণ করল। সেখানে সেই শিশুর পিতামাতাকে সন্দেহ না করে ঘটনার সাত দিন পরে কেন মর্জিনাকে সন্দেহ করা হলো? আইন ও সাক্ষ্যের দৃষ্টিতে জিনের দেওয়া তথ্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা বিখ্যাত বস্নাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলাটি রেফারেন্স হিসেবে বিজ্ঞ আদালতে পেশ করি।
অ্যাডভোকেট তাসমিরুল ইসলাম উদয়
  ০১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

কলাবাগানে নবজাতক হত্যার সন্দেহে আটক গৃহকর্মী মর্জিনার অভিযোগের বিষয়টি আলোড়িত হওয়ার কারণ ছিল, নিহত নবজাতকের মা ফেসবুক লাইভে এসে দাবি করে গৃহকর্মী মর্জিনা তার পঁচিশ দিন বয়সি শিশুকে হত্যা করেছে। লাইভ ভিডিওটি এত পরিমাণে শেয়ার হয় যে, সোশ্যাল মিডিয়াতে রীতিমতো ঝড় শুরু হয়ে যায়। বুদ্ধিমান ও বিবেক সম্পন্ন মানুষরা শুরুতেই মায়ের গল্পকে সন্দেহের চোখে দেখে। আমি নিহত শিশুটির মায়ের বক্তব্য শোনার পরে ঘটনার বিষয়বস্তকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। আমি সিদ্ধান্ত নেই, আমি ও আমার চেম্বার মর্জিনার পক্ষে বিনা খরচে আইনি লড়াইয়ে যাব।

নিহত শিশুর বাবা তার অভিযোগে উলেস্নখ করেন, বিগত ০১/০৫/২০২৩ তারিখ সকালে তিনি এবং তার স্ত্রী ফজরের নামাজ পড়ে ৬টার দিকে ঘুমাতে যায়। এরপর সকাল ৯টায় তার (নিহতের বাবা) মোবাইলে একটা কল আসলে তিনি ঘুম থেকে উঠে তার সন্তান জায়ানের নিথর দেহ দেখতে পান।

বাচ্চার কোনো নড়াচড়া না দেখে তিনি বাচ্চাকে চিৎ করে শোয়ালে বাচ্চার নাকে-মুখে রক্ত ঝরে পড়ে। এ অবস্থায় তারা বাবা-মা চিৎকার করলে উঠে বাচ্চাকে দ্রম্নত গ্রিনলাইফ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেই দিনই কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশু জায়ানকে মৃত ঘোষণা করে এবং যথারীতি শিশুকে দাফন করা হয়।

এই ঘটনার সাত দিন পর ০৭/০৫/২০২৩ তারিখে ভিক্টিমের মাতা মাহী নামীয় ওই নারী দাবি করেন তার ওপর জ্বিন আছর করেছে। এবং জ্বিন তাকে বলেছে যে, গৃহকর্মী মর্জিনাই তার সন্তানকে হত্যা করেছে। এরপর মর্জিনা ও তার শিশুদের প্রাণে হত্যার ভয় দেখিয়ে মোবাইলে ধারণ করা হয় জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি। সেই স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও দেখিয়ে পুলিশে অভিযোগ করলে পুলিশ মর্জিনাকে গেপ্তার করে। এরপর নিহত শিশুর খড়হম ইড়হব উঘঅ প্রোফাইলিংয়ের জন্য বিজ্ঞ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বরাবর আবেদন করা হলে, বাচ্চার লাশ কবর থেকে উত্তোলনের আদেশ দেন।

আমরা যখন মর্জিনার ওকালতনামা হাতে পাই তখন প্রায় জুন মাসের শেষের দিকে চলে আসে এবং ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় মর্জিনাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। মামলার তদন্ত অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে সন্তোষজনক কোনো উত্তর পাইনি। না সন্তুষ্ট হতে পেরেছি অগ্রগতি সম্পর্কে, না সন্তুষ্ট হতে পেরেছি সংস্থার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে। আমরা একপর্যায়ে বিজ্ঞ আদালতে পিডবিস্নউএর আবেদন করে মর্জিনাকে আদালতে হাজিরপূর্বক জামিন শুনানির আবেদন করি। বিজ্ঞ আদালত জামিন শুনানির জন্য ২৩/০৭/২০২৩ তারিখ ধার্য করেন এবং একই সঙ্গে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ দান করেন।

এই মামলার প্রতিটি ফ্যাক্ট সম্পর্কে শুরু থেকেই অবজারভেশনে রেখেছিলাম এবং প্রয়োজনীয় আইন ও নজির সংগ্রহ করছিলাম। শুনানির আগের দিন অর্থাৎ ২২/০৭/২০২৩ তারিখ সকালে আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে কিছু জটিলতা তৈরি হলে জরুরি ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ২৩/০৭/২০২৩ তারিখে মর্জিনার মামলার শুনানি ছাড়াও চেম্বারের আরও একটি জটিল মামলায় জেরার প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে আমাকে অনন্যোপায় হয়ে আমার স্ত্রীকে আমার মায়ের কাছে হাসপাতালের লেবার রুমে রেখে মামলার প্রস্তুতির জন্য আমাকে বাসায় চলে আসতে হয়। পরবর্তী সময়ে রাত ১০:০০ ঘটিকায় আমি হাসপাতালে পৌঁছালে আমার স্ত্রীকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। আলহামদুলিলস্নাহ, বাচ্চা ও তার মা দুজনই বর্তমানে সুস্থ ও ভালো আছে।

২৩/০৭/২০২৩ তারিখ সকাল ১১:৩০ ঘটিকায় মর্জিনার মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয় বিজ্ঞ এমএম আদালত নং- ২৩, আতাউলস্নাহ সাহেবের আদালতে। মামলার শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন আমার সিনিয়র আইনজীবী ভাই অফা ঝযধফধঃ ইধঢ়ড়হ এবং জুনিয়র আইনজীবী অফা ঝযধসরস।

শুনানিতে আমরা আমাদের বক্তব্যে আদালতকে বলি, সিআরপিসির ৫৪ ধারায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশের কাছে অপরাধ সংঘটনের ঈৎবফরনষব ওহভড়ৎসধঃরড়হ এবং জবধংড়হধনষব ঝঁংঢ়রপরড়হ-এর বস্তুগত উপাদান বিদ্যমান থাকতে হবে। একটি শিশু নিহত হওয়ার সাত দিন পর তার মায়ের দাবি যে তার ওপর জিন আছর করে বলল, তার বাচ্চাকে মর্জিনা হত্যা করেছে কাজেই তাকে গ্রেপ্তার করো! জিনের দেয়া তথ্য কি করে একজনকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ঈৎবফরনষব ওহভড়ৎসধঃরড়হ হতে পারে? যেই শিশু তার পিতা মাতার সঙ্গে লকড রুমে হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃতু্যবরণ করল। সেখানে সেই শিশুর পিতামাতাকে সন্দেহ না করে ঘটনার সাত দিন পরে কেন মর্জিনাকে সন্দেহ করা হলো? আইন ও সাক্ষ্যের দৃষ্টিতে জিনের দেয়া তথ্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা বিখ্যাত বস্নাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলাটি রেফারেন্স হিসেবে বিজ্ঞ আদালতে পেশ করি।

একটা স্বীকারোক্তি দেখানো হচ্ছে, যেই ভিডিও তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এটা জোরপূর্বক ধারণ করা। এরপরেও মর্জিনার কারাগারে থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে? মর্জিনার দরিদ্রতা? এ সময় বিজ্ঞ আদালত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জবাব দিতে বললে তিনি কোনো যৌক্তিক তথ্য ও জবাব দিতে পারেননি। কিন্তু বিজ্ঞ আদালত এই বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি।

যেহেতু এখানে একটি হত্যার অভিযোগ আছে এবং শিশু হত্যার মতো সেন্সিটিভ ও ভাইরাল ইসু্য হওয়ায় তিনি জানান, আদেশ পরে হবে। সাধারণত আদেশ পরে হওয়ার অর্থ আমরা কাঙ্ক্ষিত রেমেডি পাচ্ছি না। মর্জিনাকে কারাগারের উদ্দেশে এবং তার পরিবারকে রাজবাড়ীর উদ্দেশে বিদায় দিয়ে আমি আমার বাসায় এসে যখন হাসপাতালে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আদালত থেকে আমাকে ফোন কল করে জানায়, আমি এবং মর্জিনার পরিবার এই মুহূর্তে যেখানেই থাকি না কেন অবশ্যই যেন 'কোর্ট আওয়ারের' মধ্যে আদালতে হাজির হই। মর্জিনার পরিবার ইতোমধ্যে গাবতলী পর্যন্ত চলে যায়। তাদের পুনরায় আদালতে ফেরত আসতে বলি। তারা একটি সিএনজি নিয়ে চলে আসে এবং আমি, আমার বাসা থেকে পুনরায় আদালতের উদ্দেশে রওয়ানা হই। জুনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম আদালতে গিয়ে অপেক্ষমাণ থাকে যেন প্রয়োজনে আদালত থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নিতে পারে। অতঃপর বিকাল ৪ ঘটিকায় আমি ও মর্জিনার পরিবার বিজ্ঞ আদালতে উপস্থিত হলে বিচারক আতাউলস্নাহ মর্জিনার আত্মীয়স্বজনদের নাম, ঠিকানা যাচাইপূর্বক মর্জিনাকে দুই হাজার টাকা বন্ডে জামিনে মুক্তির আদেশ প্রদান করেন।

মামলাটি এখনো শেষ হয়ে যায়নি। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন আসা পর্যন্ত মামলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে যেতে হবে। তবে ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে মর্জিনাকে যেভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে তা ফৌজদারি আইনের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখানে আসল সত্যকে আড়াল করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখার আছে। এই ধরনের অভিযোগে একজন মানুষকে বিনা বিচারে ৭৫ দিন জেল হাজতে থাকতে হয়েছে! যার ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সহজেই অনুমান করা যায়। এ দেশের বিদ্যমান ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম এখন পর্যন্ত তার ঔপনিবেশিক আচরণ থেকে বের হতে পারেনি এমনকি এর সংস্কার নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা পক্ষের কোনো মাথা ব্যথা লক্ষ্য করা যায়নি। যার প্রতিনিয়ত বলি হয়ে চলেছে মর্জিনার মতো সাধারণ নাগরিকরা।

তাসমিরুল ইসলাম উদয়, আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে